মা হুরমতজান বিবি কিছুদিনের মধ্যেই পুত্র হাসন রাজাকে নিয়ে লক্ষণশ্রীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্বামী উবায়দুর রাজা ও শশুর আলী রাজার পরলোক গমনের পর রামপাশার বাড়িতে বিধবা পুত্রবধু সজিদা বানু একাকী হয়ে যান। এ সময় সিলেট থেকে সহিফা বানু কিছুদিনের জন্যে তাঁর বড় ভাবি ও সই সজিদা বানুকে সঙ্গ দিবার জন্যে রামপাশায় চলে আসেন। পরের বছর ১৮৭২ সাল শাশুড়ি হুরমতজান বিবি ও দেবর হাসন রাজাকে চিঠি লিখে খবর পাঠালেন সজিদা বানু- ‘কিছুতেই আর রামপাশার বাড়িতে থাকা যাবে না।’ এক মন্ডলের পুত্র রামপাশার দহলিজে বসে মরহুম আলী রাজা সাহেবের হুক্কাটি নিয়ে নিশ্চিন্তে ধুমপান করার ¯পর্ধা দেখে সজিদা বানু পিত্রালয় উজানডি কর্ণমধুতে পাড়ি জমান।
ওদিকে হাসন রাজা মৃত ভাইয়ের শিশু পুত্রদ্বয় সম্বন্ধে যেমনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত, অন্যদিকে ইরশাদ রাজা ও ইজ্জাদ রাজার নানান উপদ্রবে জমিদারী পরিচালনায় হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। প্রতিদ্বন্দী জমিদার ও বিদ্রোহী প্রজাদের সঙ্গে নানাবিদ মামলা মোকদ্দমাও অতিষ্ট করে তুলে। এসব জমিদারদের মধ্যে তেঘরিয়ার পার্শ্ববর্তী মল্লিকপুরের নবীনচন্দ্র শর্মা বি.এল. সিলেট জজকোর্টের খ্যাতনামা উকিল ছিলেন এবং তার ইঙ্গিতে তার জ্যেষ্ঠ ভাই গোবিন্দচন্দ্র শর্মাও হাসন রাজার সঙ্গে ঘোরতর শত্রুতায় লিপ্ত হন। হাসন রাজার বিরুদ্ধে সর্বসাধারণকে উত্তেজিত করার চেষ্টায় তিনি প্রায়ই লিপ্ত থাকতেন। তবে কিছুতেই সফল হতে পারেননি।
আমির বক্স চৌধুরীর সাথে হুরমতজান বানুর বিয়ে হয়ে প্রথম যখন সুনামগঞ্জে আসেন, তখন বাপের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার খালিয়াজুরি পরগনার বল্লী হতে বেশ কিছু দাসদাসী সাথে করে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য হুরমতজান বানু স¤্রাট আকবরের সভাসদ ও নব রতেœর অন্যতম শ্রেষ্ট রত্ন আবুল ফজল কর্তৃক আকবর নামাতে বর্ণিত মসনদে আলা ঈশা খানের সাহায্যদানকারী মজলিস দিলওয়ারের সাক্ষাৎ বংশধর। প্রথা অনুযায়ী আমির বক্স চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে হাসন রাজা পরিবারও যৌতুক হিসেবে প্রাপ্ত এই সমস্ত দাস-দাসীদের ভরণপোষণ এবং বিয়েসাদীর ব্যবস্থা করতেন। এই দাসদাসীদের এক পরিবারে আয়াত নামে একটি ছেলে জন্মগ্রহণ করে। সেটি ছিল মুসলমান দাসের ঘর আর অন্যটি হিন্দু দাস পরিবারে জন্ম নেয়া সুরজান নামে এক মেয়ে। পরে তাদের দুজনার বিয়ে দেওয়া হয়।
আয়াতের স্ত্রী সুরজানের মা-বাবার ঘরে প্রথা অনুযায়ী নিয়মিত ধর্মীয় রীতিনীতি ও পুজা-পার্বন চলতো, তাতে মেয়ের বিয়ে মুসলমান ঘরে দেয়া ততখানি বাধসাধের ব্যাপার ছিল না। সুরজান ছিল হাসন রাজার গানের আসরের সুমধুর সুরের গায়কি গলার একজন নিবেদিতা যুবতী। সে হাসন রাজার অনেকখানি ভক্তও ছিল। কোনো কোনো সময় তার গানের সুরশ্রীতে হাসন রাজা ভাবাবেগে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ওদিকে গোবিন্দচন্দ্র শর্মা সর্বদাই হাসন রাজাকে পর্যূদস্ত করতে উদগ্রীব। একদিন হাসন রাজার এই দাসদাসীকে গোপনে যোগাযোগ করে প্রলোভনে বশীভূত করলেন তিনি এবং এক রাতে তেঘরিয়া ত্যাগ করে স্ত্রীসহ আয়াত তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হতে সম্মত হয়। আয়াত এবং তার স্ত্রী সুরজানকে অনেক লোভ লালসায় ফুসলিয়ে হাসন রাজার বিরুদ্ধে একটি ধর্ষনের অভিযোগ আনলেন গোবিন্দচন্দ্র। গোবিন্দচন্দ্র শর্মার অপর ভাই নবীনচন্দ্র শর্মা বি.এল. সুন্দর করে সাজিয়ে অভিযোগটি দায়রা আদলতে উপস্থাপন করেন। অভিযোগের স্বপক্ষে ডাক্তারের একটি মিথ্যা রিপোর্টও সংগ্রহ করা হয়।
‘সুনামগঞ্জে তৎকালীন কোনো এক হাকিম অতঃপর প্রাথমিক পর্যায়ের বিচারের পরে তাকে দায়রা কোর্টে সোপর্দ্দ করেন। দুর্বল এই মামলার উপর ভিত্তি করে দায়রা আদালতে হাসন রাজার দেড় বছরের জেল হলেও হাই কোর্টে আপিল করার ফলে হাসন রাজা সুবিচার পান এবং সমস্ত ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনাটি দিনের আলোর মত স্পষ্টতর হয়ে উঠে। তার ফলে হাসন রাজা নিষ্কৃতি লাভ করেন। যেসব সাক্ষী সাবুদের উপর নির্ভর করে যে দায়রা আদালত জজ হাসন রাজাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল, মহামান্য হাইকোর্টের দুজন ইংরেজ বিচারপতি অধস্থন কোর্টের দায়িত্ত্বহীন রায়কে কটুক্তি করতে ক্রুটি করেননি।
এই ঘটনার তিন চার বছর পর আয়াত কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়লে পাড়া প্রতিবেশী তাকে ভৎর্সনা দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি এবং হাসন রাজা সাহেবের পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবার পরামর্শ দেয়। একদিন হাসন রাজা তার সখের কোড়া পরিচর্চা করছিলেন, এমন সময় ছালা দিয়ে হাত-পা ঢাকা অবস্থায় আয়াত এসে পা স্পর্শ না করে মাথা নত করে সালাম জানায়। হাসন রাজা আয়াতের এই অবস্থা দেখে অভিভূত হয়ে তার বাল্যকালের সাথী আয়াতকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোর এ দশা হয়েছে কবে?’ আয়াত প্রত্যুত্তরে মিনতিমাখা সুরে বলে- ‘এ সবই আপনার বদ দোয়ায় হয়েছে, মনিব!’ অতঃপর তিনি আয়াতকে ক্ষমা করে দিয়ে তার জীবদ্দশা পর্যন্ত মাসিক ষোল টাকা করে বৃত্তি দিতেন। আয়াত সে বৃত্তি পয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত ভোগ করেছিল। আয়াতের স্ত্রীরও কুষ্ঠ ব্যাধির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্যত্র চলে যায়।
গনিউর রাজার তথ্যকথার দলিল থেকে উদ্ধার করা হয় যে, হাসন রাজা যখন রামপাশায় অবস্থান নিতেন, তখন ‘কটাইর মা বেটির ঘরটিতে তক্তা মোড়া দিয়ে একটি কাঠের বাক্সের মত করে তাতে তিনি রাত যাপন করতেন। কটাইর মা’র নিরাপদ আশ্রয় দান হাসন রাজা কোনোদিন ভুলেননি। ধাত্রীমাতা কটাই মায়ের এই স্নেহ উপকারের স্বীকৃতিস্বরূপ হাসন রাজা পূর্ণবয়স্কা এই মহিলার জন্যে নিয়মিত ভাতা, জমি ও আবাসের ব্যবস্থা করেন। এমনকি কাপড় ও খাবার সংস্থানের জন্যে তার জমিদারী নায়েবের (ম্যানেজার) উপর চিরস্থায়ী একটি লিখিত নির্দেশ জারি করেন। ক্রমে ক্রমে প্রচুর কষ্ট, তিতিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হাসন রাজা পৈত্রিক আবাস স্থল ও স¤পত্তিতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তার বদান্যতা শুধুমাত্র রামপাশার প্রজাগণকে মুগ্ধ করেনি বরঞ্চ তাদেরকে নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে। হাসন রাজার প্রথম জীবনে ভীষণ শত্রুতা করার পরও ইরশাদ রাজা ও ইজ্জাদ রাজা উভয়ই অবশেষে তার আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তার থেকে তারা যথেষ্ট পরিমাণে সহায় সম্পত্তিও লাভ করেন।
এরপরও হাসন রাজা মাঝে মধ্যে কারনে অকারনে ঈর্ষান্বিত শত্রুদের কোপানলে পড়তেন। হাসন রাজার রামপাশা বাড়ির বিশ্বস্ত কর্মচারী ঝারু খা’র বর্ননায় পাওয়া যায় রামপাশার প্রজাবিদ্রোহ তো নয় সেটি মুলুকরাম সাহজির মত লোকেদের উঠিপড়ি শত্রুতার কর্মকান্ড ছিলো । অল্প বয়সের যুবক হাসন রাজার কোন চাকচিক্য ছিলো না বরঞ্চ বংশানুক্রমিক বিশাল সম্পতির মালিক ছিলেন বলে তখন তার কিছু সৌখিনতাই তাকে সে যুগে স্থানীয় সুখ্যাতি দিয়েছিলো, তার মধ্যে কুড়া পাখি, ময়না পাখি লালন পালন আর ঘোড়দৌড় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে তার এই সৌখিনতা স্থানীয় জমিদার মিরাশদারগনের ঈর্ষার কারন হয়ে দাড়িয়েছিলো। একবার লক্ষনশ্রীরই আরেক জমিদার হাসন রাজার উপর এক কুচক্রী ফন্দি আটলেন। হাসন রাজা তখন টাংগুয়ার হাওড় থেকে কুড়া শিকার করে ঘরে ফিরছেন। ঘরে আসতে আসতে তার অনেকখানি বিলম্ব হলো। হাওড় এলাকা ছেড়ে মাত্র সুরমা নদীতে এসে পড়বেন, এমন সময় কিছু লোক রাতের অন্ধকারে তার নৌকাটি থামিয়ে দিলো, তাদের হাতে ছিলো লাটি সুটা । হাসন রাজার সাথের লোকেদের মধ্যে তখন ভয়ের সঞ্চার ঘটে। হাসন রাজা নির্ভয়ে নৌকার ভিতর থেকে বাহির হন এবং তার একজন লোককে আদেশ করলেন লেন্টনের আলোটি তুলে ধরার জন্যে। সেই আলোয় আলোকিত হাসন রাজার মূখমন্ডলটি এই রাতের অন্ধকারে যেনো আকাশের চাদের মতো উজ্জল এক প্রভা ছড়িয়ে দিলো। জমিদারের লোকেরা বা ডাকাতেরা এই ছয় ইঞ্চি দীর্ঘাকায় এই উজ্জল মানুষটি সাক্ষাৎ পেয়ে তারা গৌর গৌর বলে চিৎকার করে উঠে এবং হাসন রাজার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। উদার হাসন রাজা সবকিছু জেনে নিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
বাবার মৃত্যুর প্রায় বছর দশেক পর একবার হাসন রাজা মা হরমুতজাহান বিবি ও প্রথম স্ত্রী ভুরজান বিবিকে সঙ্গে নিয়ে রামপাশায় উপস্থিত হন। জ্ঞাতি কাকা তারকচন্দ্র চৌধুরী ও মুকুলরাম সাইচি হাসন রাজাকে পরাজয় দেবার উদ্দেশ্যে রামপাশার প্রজা বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিবার জন্যে সচেষ্ট হন। হাসন রাজা নানাবিধ মামলা মোকাদ্দমায় তাদের কাবু করে ফেললে অবশেষে বিদ্রোহীদের এক জলসায় সাব্যস্থ হয়,- আজম (ওরফে আকবর) নামে একটি দুর্দান্ত লোক গভীর রাতে হাসন রাজার অন্দর মহলে প্রবেশ ক’রে, তাকে রামদা দিয়ে দিখন্ডিত করবে। মজলিসের সিদ্ধান্ত অনুসারে আকবর তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্য লোকজনদের নিকট থেকে বিদায় নেয়।” হাসন রাজার শোবার ঘরে প্রবেশ করে। রাতের প্রথম প্রহরের দিকে মোমবাতির আলোতে হাসন রাজা দহলিজে বসে কিছু একটা লেখাজুখা করছিলেন। কোন একটি গানের সৃষ্টিতে যখন মশগুল তখন আকবর ঘরে ঢুকে পড়েই বিশ্মিত হয়ে দেখে তিনি মোমবাতি জ্বালিয়ে গান রচনা করছেন। একমুহুর্তের একঝলকে আকবরের চোখে পড়ে অনিন্দ সুন্দর চেহারার দীপ্তিতে ঋষিসুলভ ধ্যানে মগ্ন হাসন রাজা গানের সুর ধরে গুনগুন করছেন। হঠাৎ করে হাসন রাজার কানে পায়ের শব্দ এলে মাথা তুলে চাইতেই দেখলেন রামপাশার উত্তরপাড়ার আকবর খা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একখানা লম্বা রামদা। হাসন রাজা এক নির্ভয়-ভারী গলায় জিঙ্গেস করলেন- ‘আকবর এতরাতে এখানে কেন?’ ভড়কে গেল আকবর খা! আকবরের হাত থেকে খসে পড়লো ছুড়িকা জাতিয় রামদাখানি। সে তৎক্ষণাৎ কাঁদতে কাঁদতে হাসন রাজার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এর কিছুক্ষন পরই তিনি শুধু বললেন “আমি মাপ করলাম, জলদি এখান থেকে ভাগ্। আকবর তখন সেখান থেকে দ্রƒতবেগে নিষ্ক্রান্ত হলো। পরদিন সকাল বেলা বিছানা ছাড়তেই হাসন রাজার কাছে খবর আসলো - বাড়ীর উত্তর পূর্ব দিকে যে বড় বট গাছটি ছিল তা বজ্রাঘাতে ভেঙ্গে পড়ে এবং আকবর সেখানেই মারা যায়। হাসন রাজা ঝাঁড়ুখাকে ডেকে বললেন “যা তারকা কাকাকে গিয়ে বল যে, হাসনরাজা খবর পাঠিয়েছেন, আকবরের বাকী ১০০ টাকা পাওনা যেনো পরিশোধ করে দেন। তার কাফন আর সিন্নি সালাতের খরচটি বোধ হয় এতে হয়ে যাবে”।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে হাসন রাজার পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ট ছিলেন আজিজুর রাজা (১৮৬৯-১৯৬০) যিনি হাসন রাজা থেকে ১৫ বছরেরও ছোট। তিনি হাসন রাজার একাধারে ভাতিজা এবং মেয়ের জামাই। দীঘকালীন বেচে থাকার কারনে এই কাহিনীটি তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া আমি হাসন রাজার পুত্রবধু আকলিমুন নেসার কাছ থেকেও ঐ একই কাহিনীটি শুনি এবং সম্ভবত তিনি তাঁর শাশুরি লবজান চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছিলেন।
সোনা বউ, সোনা বউ গো, তুর লাগিয়া হাসন রাজা ব্যাকুল
হাসন রাজা জানিয়াছে, তুমিই হƒদের ফুল ॥
ঘরের মাঝে পরদা দিয়া, বউ আমার থাকে
আন্দরে থাকিয়া বউয়ে, সকলের মন রাখে ॥
হাসন রাজার মা হুরমত জাহান চৌধুরানীর মৃত্যু হয় ১৩১১ বাংলার পৌষ মাসে। এর অর্থ হলো স্বামী আলী রাজার মৃত্যুর ৩৩ বছর পরে হুরমত জাহান বিবি পরলোক গমন করেন। বাবা ভাই এবং পরে মায়ের মৃত্যও তাঁর জীবনের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। আসলে হাসন রাজার জীবনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপকরণ, বিয়োগ, ঘটনা, এমনকি চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি তাকে ভাবুক বানাতে শিখিয়েছে।
বাপ মইলা, ভাই মইলা আর মইলা মাও
এব কিনা বুঝলায় হাসন এ সংসারের ভাও ॥