কলকাতার লেখক ও গবেষক অমিয়শঙ্কর চৌধুরী এই তথ্যটি প্রকাশ করেছেন- ‘হাসন রাজা বিবাহের ব্যাপারে শরিয়তের আদর্শ মানেননি। শরিয়ত অনুসারে মুসলিমদের চার স্ত্রী গ্রহণ চলতে পারে। কিন্তু হাসন রাজা চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি কোনোদিন কোনো মেয়েকে জোর করে তার অন্দর মহলে নিয়ে আসেননি।’ একাধিক বিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার জীবনে কোনো সময়ই তিনি বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেননি। লক্ষণীয় বিষয় যে হাসন রাজা সবক’টি বিয়ে সম্পর্ক করেন দুরদুরান্ত থেকে, স্থাণীয় এলাকার বাইরে। হাসন রাজা বিয়ে সম্পাদনে কোনসময়ই উৎচ্ছৃঙ্খল যথেচ্ছচারীতা ছিল না। অথচ তার বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে অনেকেই মনগড়া কথা বলেছেন।
প্রথম বিবাহ : মোহাম্মদজান ধীর নামে এক ভদ্রলোক সুদুর পাঞ্জাবের শিয়ালকোট নগরী থেকে এসে আরপিন নগর এলাকায় বসত গড়েন। মূলত মোহাম্মদজান পরিবার পাঞ্জাব সংলগ্ন ধীর রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। পরে তারা পাঞ্জাবের শিয়ালকোট নগরীতে স্থানান্তরিত হয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। পিতা পির গোল মোহাম্মদ ধীরের নির্দেশে আহমদজান ধীর এবং মোহাম্মদজান ধীর হজ্জব্রতী মুসলমান যাত্রীদের সাহায্যার্থে বাংলা-আসামে পাড়ি জমান। এলাকার মুসলমানদের হজ্জ-যাত্রা আয়োজন এবং সরঞ্জাম-ব্যবস্থাদির নিয়ে তাঁদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আহম্মদজান সিলেট সদর থানার জলালপুরে আনসারী পরিবারে বিবাহ করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। আর মোহাম্মদজান ধীর সুনামগঞ্জের আরপিন নগরের আব্দুস সামাদ তালুকদারের বোনকে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই আব্দুস সামাদের বংশধররা এখনও সুনামগঞ্জের আরপিন নগরস্থ তালুকদার বাড়িতে বাস করছেন। মোহাম্মদজান ধীরের এক কন্যাসন্তান ছিলেন। সেই কন্যা পরমাসুন্দরী ভুরজান বানুকে দেখে তরুন হাসনের মনে এক প্রেমানূভূতি জাগে। হাসন রাজার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর।
মা হুরমতজাহান বিবির অনুমতিতে ১২৭৯ বাংলার মোতাবেক ১৮৭৩ সালে হাসন রাজা ও ভুরজান বানুর মাঝে বিয়ে স¤পন্ন হয়। পরের বছর ১৮৭৪ সালে প্রথম পুত্র গনিউর রাজার জন্ম। এই স্ত্রীর গর্ভে দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাসিনুর রাজা ১৮৭৬ সালে এবং এক কন্যা রওশন আক্তার বানু জন্ম হয় ১৮৭৯ সালে। হাসন রাজার জীবদ্দশায় ১৯০৫ সালে রওশন আক্তার বানু মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। এই কন্যা বিয়োগে বহুদিন হাসন রাজা একরকম উন্মাদের মত ছিলেন। ভুরজান বানু চিরদিনের অভ্যাসমত মাটির মধ্যে ঘুমোতে যেতেন। পরে হাসন রাজা তার জন্যে তার ঘরের ভিতরে মাটি দিয়ে উঁচু করে একটি ‘মাটির চৌকি’ তৈরি করিয়ে দিন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাকি জীবনের প্রায় ৩০ বছরের মত সময় তিনি এই মাটির চৌকিতে রাতের বেলায় গুমাতেন। তাঁকে ঘরের লোকেরা ও পাড়া-প্রতিবেশীরা ‘মাটির চৌকির বিবি’ বলে সম্বোধন করতো। হাসন রাজার মহাপ্রস্থানের পর তিনি আর বেশীদিন বেঁচে থাকেননি। তাঁর কবর স্থানটি হাসন রাজার কবরের পাশেই।
দ্বিতীয় বিবাহ : ১২৮৪ বাংলা ২৯ শে বৈশাখ হাসন রাজা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। স্ত্রী হবিগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত নবীগঞ্জের র্কুশা খাগাউরার প্রসিদ্ধ দেওয়ান পরিবারের দেওয়ান মোহাম্মদ আছির সাহেবের কন্যা আজিজা বানু। এই স্ত্রীর গর্ভে হাসন রাজা সাহেবের দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। তারা যথাক্রমে রওশন হুসন বানু (১৮৭৮-১৯৫৪) ও রওশন হাসন বানু (১৮৮১-১৯৫০)। রওশন হুসন বানুই প্রখ্যাত দেওয়ান মোহম্মদ আজরফ সাহেবের মা। হাসন রাজার মৃত্যুর প্রায় বছর ছয়েক পর আজিজা বানু মারা যান। তার মরদেহ সুনামগঞ্জে তার স্বামীর কবরস্থানের পাশেই শায়িত করা হয়।
তৃতীয় বিবাহ : সুনামগঞ্জের ছাতক থানার অন্তর্গত পিরপুরের অতি পুরাতন চৌধুরী পরিবারের মোহাম্মদ-হোসেন চৌধুরীর কন্যা সাজিবুন নেসা চৌধুরীর সাথে ১২৮৮ বাংলা মোতাবেক হাসন রাজার তৃতীয় বিবাহ স¤পন্ন হয়। এই পক্ষে কোনো সন্তানাদি ছিল না। হাসন রাজার জীবদ্দশায় এই স্ত্রী ইহলোক ত্যাগ করেন।
চতুর্থ বিবাহ : মাত্র বছর চারেক পাঁচেক উবায়দুর রাজার ঘর সংসার করার পর সজিদা বানু বিধবা হয়ে পিত্রালয়ে পাড়ি জমালেন। বোন সহিফা বানুর হস্তক্ষেপে হাসন রাজাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে বছর কয়েক পর বড়ভাইয়ের স্ত্রী সজিদা বানুর সাথে হাসন রাজার বিবাহ ঠিক করেন। ১২৯০ বাংলা সনের ২১ শ্রাবণ সিলেটে কুয়ারপার সহিফা বানুর বাড়িতে বিবাহটি স¤পন্ন হয়। কিছুদিন পরই ১২৯৮ বাংলার পৌষ মাস নাগাদ অর্থাৎ ১৮৯২ ইংরেজি সনের জানুয়ারি মাস নাগাদ জফরগড়ের জমিদারী সম্পত্তি লংলার বিখ্যাত পৃত্তিমপাশার আলী আমজদ সাহেবের সাহেবের কাছে বিক্রি করেন। ওই টাকার দিয়ে ১৮৯টি মৌজায় বিস্তৃত কৌড়িয়ার জমিদারীর মাত্র ৮৮টি মৌজা রক্ষা করতে সমর্থ হন।
সজিদা বানুর গর্ভে দুই পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আনুমানিক ১৮৮৫ সনে জন্ম নেন শিশুপুত্র দেওয়ান আলীনূর রাজা এবং ইনি শিশু অবস্থাতেই মারা যান। পরে জন্ম নেন ১৮৮৯ সনে একলিমুর রাজা। পরবর্তীকালে তিনি কাব্যবিশারদ খানবাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা নামেই পরিচিত ছিলেন। হাসন রাজা সাহেবের চতুর্থ স্ত্রী সাজিদা বানু ১৮৯২ সালে তার পূর্ব-পক্ষের পুত্র দেওয়ান আজিজুর রাজাকে সঙ্গে নিয়া হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফে গমন করেন।
পঞ্চম বিবাহ : সুনামগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত ছাতক থানার ঘিলাচড়া গ্রামের অধুনালুপ্ত পারুয়ার অধিবাসী মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীর বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করেন হাসন রাজা। হাসন রাজার গান-বাজনায় ভরপুর লক্ষণশ্রীর বাড়ির পরিবেশে ইনি বেশিদিন ঠিকবার নয় বলে তার নিজের অভিপ্রায়ে তালাকপ্রাপ্ত হন।
ষষ্ট বিবাহ : সুনামগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত দিরাই থানার ভাটিপাড়া নিবাসী জমিদার পরিবারের মোহাম্মদ খুরশেদ চৌধুরীর কন্যা ফখরুননেসা বানু চৌধুরীকে বিবাহ করেন ১২৯৫ বাংলা সনে। এই স্ত্রী লক্ষণশ্রীতে এসে ঠিক পারুয়ার বিবির মত গান বাজনার পরিবেশে নিজেকে বেশিদিন খাপ খাওয়াতে পারেননি এবং বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
সপ্তম বিবাহ : হাসন রাজা সপ্তম বিবাহ করেন সিলেটের ঈদগাহের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। আনুমানিক ১৮৯১ সালের দিকে যখন তার বৈমাত্রেয় ভাই মোজাফ্ফর রাজার সাথে হাসন রাজার প্রায়ই দেখা হত, তখন সিলেটে থাকাকালীন সময়ে এই সম্পর্কটি স্থাপিত হয়। এই বিবির ভাইয়ের বংশধরগণ এখনও সিলেটে বসবাস করছেন। হাসন রাজার পৌত্রবধু সৈয়দা সামছুন নাহার খাতুন তথ্যটি দেন যে, এই স্ত্রী হাসন রাজার দ্বিতীয় পুত্রবধু জহুরা চৌধুরানীর আপন খালা। হাসন রাজার জীবদ্দশায় ইনি পরলোকে পাড়ি জমান।
অষ্টম বিবাহ : ১২৯৯ বাংলা মোতাবেক ১৮৯৩ সালে হবিগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত নবীগঞ্জের কুরশা পরগনার অন্যতম জমিদার দেওয়ান মজুম হোসেন চৌধুরীর কন্যা জুবেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। এই পক্ষে এক কন্যা সন্তান লাভ করেন। নাম রওশন আলী হোসেন বানু (১৮৯৪-১৯৫৮)। ইনিই হলেন হাসন রাজার সর্বকনিষ্ট কন্যা সন্তান। কন্যার বিবাহ দেন সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার অন্তর্ভুক্ত সেলবরস গ্রামের খান বাহাদুর আব্দুল হান্নান চৌধুরীর সাথে।
নবম বিবাহ : আসামের লাউর অঞ্চলের অধিবাসী সমির চৌধুরীর কন্যা লবজান চৌধুরীকে ১৩০২ বাংলা বিয়ে করেন হাসন রাজা। তার এই স্ত্রী ‘অসাধারণ সুন্দরী ও ব্যাক্তিত্বস¤পন্না’ ছিলেন। লবজান চৌধুরী হাসন রাজার জীবনের শেষ দিনগুলাতে সেবা সুশ্রসার এক বড় অবলম্বন ছিলেন। তারই গর্ভে স্বনামখ্যাত দেওয়ান আফতাবুর রাজার জন্ম হয় ১৩০৩ বাংলা সালে। হাসন রাজার বয়স যখন একচল্লিশ তখন লবজান চৌধুরীর বয়স মাত্র সতের বছর। এই গুণসম্পন্না নারী তার খ্যাতিপূর্ণ স্বামী হাসন রাজার এতখানি অন্তরের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন যে তাকে অফুরন্ত সেবাসুশ্রসা দান করতে জীবনে এতটুকু কার্পন্য করেননি। তেমনি হাসন রাজাও সর্বশেষ স্ত্রীকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপ্রাণ ভালোবাসতেন এবং দোয়া করতেন। এখনো সুনামগঞ্জ এলাকায় তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘লবজান চৌধুরী উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে’ অমর হয়ে আছেন।
২.
আগেই বলা হয়েছে সঈফা বানু যদিও বৈমাত্রেয় বড় বোন তথাপি একমাত্র বোন হিসেবে এবং মাত্র বছর তিনেক বয়সের বড় হওয়া স্বত্তেও হাসন রাজার কাছে তিনি সবসময়ই একজন অতি আপনজন ও বন্ধুর মতই ছিলেন। ১৯১৭ সালের কথা। সঈফা বানু পরলোকগমন করেন আর কবি হাসন রাজা মর্মাহত হন। ছুটে এসেছিলেন সেদিন সিলেটে। যে বোনকে কেন্দ্র করে প্রায় বছরই সিলেট শহরে আনাগোনা, সেই বোনের মৃত্যুর পরপরই যেনো সেদিন হাসন রাজার সিলেটে যাবার স্বাদটা একেবারেই ফুরিয়ে গেলো।
সঈফা বানুর মৃত্যুর পর কবি মাত্র পাঁচ বছরের মত বেঁচেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি শুধু একবারই সিলেট এসেছিলেন। সে-বছরটি ছিল ১৯২০ সাল। কবি ভীষণ অসুস্থ। শুধুমাত্র বার্ধক্যজনিত কারনেই হাসন রাজা অসুস্থ ছিলেন না, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ‘গীন্নি বেরাম’ (আঞ্চলিক ভাষায়) বারংবার মলত্যাগ করার প্রবনতায় আক্রান্ত হন। শুনা যায় ‘ঝাল’ খাবার সেবন থেকে এই রোগ দেখা দিয়েছে। তিনি মাছ ভাতের সাথে শুধুমাত্র কাচামরিচ খেতেই পছন্দ করতেন না, সাথে সাথে অনেকসময় তিনি নাগা মরিচ খেতেও বসে যেতেন।
তার গানে এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে-
ইলশা রান্ধ, কইলশা রান্ধ আরও রান্ধ রউ
ভালো করিয়া ভাজ বাঈজ্ঞন সুনাপুতের বউ।
মরিচ দিও থুরাথুরা হলইদ দিও বেশাইয়া বেশাইয়া
বাগার চড়াইয়া দেও চেত চেত করিয়া।
বাগার শুনিয়া হাসন রাজায় আইসব তার ঘরে
ভাত খাইব ছালইন লইয়া আমার পুতের বউরে।
গানটির পরিচয় তুলে ধরে হাসন রাজা বাংলার ভিন্ন রকম খাবারের সাথে কতটুকু পরিচিত তাও যেনো বলে দিয়েছেন। তিনি মাঝে মধ্যে কোরমা পোলাও খাবারও পছন্দ করতেন। কিন্তু সচরাচর মাছ ডাল ভাতই তার প্রিয় ছিল। তার খাবারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শুকনো ও কাঁচা মরিচের আধিক্য থাকত। হারিয়ে যাওয়া অনেক খাদ্য পাত্রের সংখ্যাগুলো বাদ দিলেও হাসন রাজা মিউজিয়ামে এখনো ক’টি পাত্র সংরক্ষিত আছে।
হাসন রাজার বাড়িতে এখনও তার সময়কার একটি গোলাঘর আছে। এই গোলাঘরে নানা জাতের ধান, সরিষা মজুত থাকতো। আউস, আমন ও বোরো ফসলের মধ্যে রাজভোগ, মধুমাধব, বিরুসাইল, কালিজিরা, টেফি, গছি, গছিসাইল, রাতা, সোনারাতা, রাতা বিরুন, কালাবিরুন, চেংরিবরুয়া, বালাম, মালা, পঙ্কিরাজ, ঘোটক, বিরই, মুক্তাসাইল, গোপালভোগ ও আখনি সাইল ইত্যাদি। তার মানসপটে সাদামাটা একটি ধানের গোলাঘরের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলেই সেখানে তার সাধনালদ্ধ জীবন জগতের খোঁজ পেয়েছিলেন। তাইতো বলতে পেরেছিলেন-
রঙ্গের বাড়ই রঙ্গের বাড়ইরে
বিষম উন্ধুরায় নাগাল পাইল।
উগার ভইরা থুইলাম ধান
খাইয়া তুষ বানাইল ॥
মহিষের দুধ থেকে তৈরি পনিরের ভোজন রুচিও তার কম ছিল না। হাসন রাজার বাড়িতে দুধাল গরু পালন সর্বদাই চলতো। এজন্যে বাড়ির দক্ষিণপূর্ব অংশে একটি গোয়াল ঘরের অবস্থান ছিল, যেটি লক্ষণশ্রীর মৌজা ম্যাপেও অনায়াসে আজও খুঁজে পাওয়া যায়। হাসন রাজা আরেক সখের খাদ্য ছিল দুধ ভাত, সাথে আম কলা। তার সময়ে বাড়িতে প্রচুর আম, জাম, কাঠাল ও বরই (কুল) গাছের অস্থিত্ব ছিল।
হাসন রাজার সময় কোনো পারফিউম বা সেন্টের প্রচলন এখনকার যুগের মত ছিল না। জানা যায় ‘অতি প্রাচীনকালে সিলেট থেকে সুগন্ধী আগর কলকাতা, সুদূর আরব ও তুরস্কে রপ্তানী হতো। হাসন রাজাও ছিলেন আতরের সমজদার। তার প্রিয় আতরটি ছিল চন্দন কাঠের সুগন্ধি।
হিন্দুবংশীয় পূর্বপুরুষেরা থাকার কারণে নয় বরঞ্চ হাসন রাজা ব্যক্তিগতভাবে সন্ধ্যা এবং রাতের প্রথমার্ধে ধুপের ধোঁয়া তার ঘরময় সুগন্ধি ছড়াতে ভালবাসতেন। হাসন রাজার গানের চর্চার সময়টা ছিল লোকে লোকারণ্য। এক গোত্র মানুষকে সাথে নিয়ে গানের রচনা, গানের কলি আর সুরের ঝংকার সৃষ্টির আলোকজ্জল মুহূর্ত। কেউ হাসন রাজার সাথে গলা মিলাচ্ছে, কেউবা তবলায় চাটি মারছে, বাঁশিতে কেউ সুরের ঝর্নাধারা বইয়ে দিচ্ছে। সেই পাগল করা সুরের তালে চুটকি আর ছন্দময় তালির মাঝেই অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের অজান্তে। তাইতো তার সেই সুরের রশ্মি আজও আলোকিত করে প্রতিটি মানুষের হƒদয়কে। তার আসরে অন্ততপক্ষে ষোল জন মহিলা গায়িকা এবং দশ জন পুরুষ গায়ক নিয়মিত গান করতেন। তার আসরে অন্ততপক্ষে ষোল জন মহিলা শিল্পীদের গানের আসর বসত বাড়ির বৈঠকখানায় সুরমা নদীতে ভাসমান বজরায়, অচিন্তপুরের বাউল আসরে, সদরগড়ের সবুজ বাগান বাড়িতে, আবার কখনো কখনো খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে।
বসতবাটিতে গানের আসরে একটি টুলের মতো টেবিলে ছড়ানো কিছু কাগজপত্র নিয়ে হাসন রাজা ডুব দিতেন ভাবজগতে, বুনতেন কথার জাল আর মেলাতেন সুর। এ ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তিনি যেন গানের দলের মাঝ থেকে এক ভীষণ খেলায় মত্ত হতেন। অনেকের মাঝে থেকেও কখনো কখনো হারিয়ে যেতেন ভাবনালোকে। তখন দু’গাল বেয়ে অঝোরে ঝরত অশ্রুধারা। জš§, জীবন আর মৃত্যুর নিগুঢ় বাস্তব সত্যগুলো নিয়ে হাসন কথা, সুর ও তাল সৃষ্টির খেলায় যখন আকুল তখন তার চারপাশে ঘিরে থাকত গ্রাম্য এই গায়ক গায়িকাদের অতিন্দ্রিয় এক ভাব ও সুরের মূর্চ্ছনা। সুর আর লয়ে শুধু নয়, গানের কথায়ও যেন তাদের মনপ্রাণ উদ্বেলিত হয়ে উঠতো।
গনিউর রাজা সূত্রে জানা যায়, হাসন রাজা তার বাড়ির অন্দরমহল ঘরের পিছনে পুকুরপাড়ে যে ঘাটটি রয়েছে সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে চাইতেন। পুকুরের ঘাটে বসে হাওর ও নিঃস্তব্দ রাতের চন্দ্রবোলকন তথা প্রকৃতির ভিতরে নিজেকে বিলীন দেখতেন। এই পুকুর ঘাটে বসেই উত্তর-পশ্চিম কোনা দিয়ে সুরমা নদী বরাবর নীল পাহাড়ের হাতছানি তাকে বিভোর করে রাখতো। সবুজ জঙ্গল পরিবেষ্টিত নিস্তব্ধ পুকুর পরিবেশে দোয়েল ও সারসের ডাক তাকে বিমূঢ় করে রাখত। যে ঘাটটিতে বসে তিনি তার একান্ত সময়গুলো কাটাতেন তা আজ হাজারো পর্যটকের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে এই পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্তের মন্তব্য, ‘এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আমি যেন হাসন রাজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। কেন জানি তার সাথে আমি এখানে দাঁড়িয়ে একটি টেলিপ্যাথিক কানেকশন বোধ করছি। একি অপূর্ব পরিবেশ।’