3

03/15/2025 হাসন লোক উৎসব

হাসন লোক উৎসব

আবু তালহা ও শাহজাহান চৌধুরী

৬ আগস্ট ২০২১ ২৩:৫০

সুনামদি থেকে সুনামগঞ্জ। হাওর-বাওর, সবুজঘন গাছ, সুরমার সবুজ জলে ঘেরা এই শহরের সর্বত্রই মিশে আছে একটি নাম, মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা। শহরের গলিতে গলিতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই সুপরিচিত এই নাম। একইসঙ্গে জারি রয়েছে তার মরমিবাদের চর্চাও।

বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে এক শ্রেণির মানুষ তার রচিত গানের মধ্যদিয়ে ধরে রেখেছেন হাসন মরমিবাদ। হাসন রাজার পরিবার থেকেও বিলীন হয়ে যায়নি তার দর্শন। বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে হাসন রাজার মরমিবাদ চর্চার পাশাপাশি প্রথাও।

পরিবারের উদ্যোগে ২০০০ সালের পর থেকে হাসন রাজার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হয়। তার স্মরণে বাউল এবং হাসন প্রেমীরা একত্রিত হয়ে গান পরিবেশন করেন। তাদের কাছে হাসন রাজা স্মরণ হলেও পারিবারিকভাবে হাসন রাজার প্রথা হিসেবেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।

পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বাউল জীবন যাত্রায় আপ্লুত বাউলা মন, উৎসবপ্রেমী সূফি-সাধক হাসন রাজা নিজেও আনন্দের জন্য সার্বজনীন উৎসবের আয়োজন করতেন। যা ‘ফকির মেলা’ নামে পরিচিত ছিলো। সেখানে আশে-পাশের গ্রামের বাউলরা এসে গান পরিবেশন করতেন। তার গানের সখি আরবদী বলেছিলেন “রাজার ‘ফকির মেলা’ কেবল দেশে নয়, রাণী ভিক্টরিয়ার দরবারে পৌঁছে গেছে”। আরবদী একটি গানও রচনা করেছিলেন ‘সাহেব দেওয়ান হাসন মেলা বসাইয়া করলা আজব তামাশা’। ”

হাসন রাজার চেয়ে মাত্র ২০ বছরের ছোট তার বড় ছেলে রাজা গণিউরের রেখে যাওয়া নথি থেকে জানা যায়, হাসন রাজার পরবর্তী প্রজন্মও এই উৎসবের আয়োজন করতেন। সেই প্রথাতেই এখনও হাসন লোক উৎসবের আয়োজন করা হয়ে আসছে।

পূর্ব-পুরুষের নথিপত্র থেকে যে হাসন রাজার পরিচয় পাওয়া যায় সিনেমার হাসন রাজার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। বর্তমানে তাকে জমিদার সাজানো হলেও যতদূর জানা যায় খুব কম বয়সে রাজা হওয়ার পরও তার ভেতরে কোনো ধরণের মোহ ছিল না। সে সময় প্রচলিত নিয়মে তারও নয়জন স্ত্রী ছিল। তবে তিনি ছিলেন সৌখিন, ভ্রমণ বিলাসী, পাখিপ্রেমী। প্রায় ৫’শ এর অধিক প্রজাতির পাখি ছিল তার বাড়িতে। রাজা হলেও তার নেশা ছিল শুধুই পান।

হাসন রাজার খুব পছন্দ ছিল কাঁচা পয়সা বাচ্চাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া। তাদের পয়সা কুড়িয়ে নিতে দেখে হাসন রাজা খুবই আনন্দ পেতেন। এদের মধ্যে থেকেই পরবর্তীতে দিলারাম, সুন্দর চান, সাজ্জাদ এরা গানের সঙ্গী হয়।

সামারীন দেওয়ান বলেন, হাসন রাজার মরমিবাদী হয়ে ওঠার নানা কারণ ছিল। ছোট বেলা থেকেই তার মা তাকে চোখে চোখে রাখতেন। কারণ তার আগের পক্ষে চার সন্তান গর্ভে মারা যায়। হাসন রাজার বৈমাত্র বড় ভাই মারা যাওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় তিনি বাবাকে হারান। ২৫ অথবা ২৬ বছর বয়সী মেয়েকে হারানোর পর এক আমূল পরিবর্তন আসে তার জীবনে। মেয়েকে এতো ভালবাসতেন যে বারান্দার পাশেই মেয়ের সমাধি করেন। তার বিষন্নতা আরো বেড়ে যাওয়ায় পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুকুর পাড়ে পুনরায় সমাধি করেন। অথচ অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কফিনে করে তৃতীয় বারের মতো গাজীর দরগাতে মেয়ের সমাধি করা হয়। তারপর থেকে প্রায়ই তাকে গাজীর দরগাতে একা বসে থাকতে দেখা যেত।

অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের গবেষণা থেকে জানা যায়, একবার ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে একদল লোক এসেছিল দেখতে একই ব্যক্তি রাজা এবং কবি। হাসন রাজার বাসার সামনে এসে পথচারিকে বলে আমরা হাসন রাজার বাড়িতে যেতে চাই। পথচারি তাদের গাজীর দরগাতে নিয়ে একটি নির্মাণাধীন কবর দেখিয়ে বলেছিলেন এটা হাসন রাজার স্থায়ী বাড়ি আর আমি হাসন রাজা।

আমরা ধারণা করি ১৮৯৭ সালে আসাম-সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্পে অনেক মানুষ নিহত হওয়ায় মূলত তিনি পুরোপুরি মরমিবাদী হয়ে ওঠেন। ভূমিকম্পটি তাকে এতো বেশি নাড়া দিয়েছিল যে প্রায় ১০টি গানে তিনি ভূমিকম্পের বিষয়টি এনেছেন। একটি গানই রয়েছে ‘আমি তার রূপ দেখেছি’।

গান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাসন রাজার গান বিভিন্ন শহরে এবং ফিউশন মিউজিকে যেভাবে গাওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারায়। হাসন রাজার গান গুলো একক গীত হিসেবে দেখানো হলেও আসলে সবই দলীয় গীত। তবে এখনও গ্রামে গঞ্জে বাউল সম্প্রদায় হাসন রাজার গানের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তার গানের মূল বিষয় ছিল ‘সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে’।

পারিবারিকভাবে আমরা চাই সেই ফকির মেলা’র মতো আয়োজনে ফিরে যেতে। ‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে জাদুঘর প্রাঙ্গণে হাসন প্রেমীদের মরমিবাদ চর্চার জায়গা করে দিতে।


লেখা: আবু তালহা ও শাহজাহান চৌধুরী
সূত্র: বাংলা নিউজ টোয়েন্টি ফোর

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: editordailymail@gmail.com, newsroom.dailymail@gmail.com