6

03/15/2025 হাসন রাজার গানে মরমি সুর

হাসন রাজার গানে মরমি সুর

সুমন কুমার দাশ

৭ আগস্ট ২০২১ ০০:৪৬

হাসন রাজা বাংলা মরমি গানের এক স্বতন্ত্র ধারা স্রষ্টা। তাঁর গান গভীর তত্ত্ববহ কিন্তু সহজ-সরল শব্দে রচিত। ফলে মানুষের মনে গভীরে দাগ কাটে। সময়ে-অসময়ে তাই গুনগুন করে বেরিয়ে আসে—'মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে', 'লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার', 'আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে', 'ছাড়িলাম হাসনের নাও রে', 'সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল', 'আগুন লাগাইয়া দিল কোনে, হাসন রাজার মনে', 'নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে', 'বাউলা কে বানাইল রে হাসন রাজারে/ বাউলা কে বানাইল রে' প্রভৃতি। উল্লিখিত গানগুলোর মধ্যে 'মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে' গানটি নিয়ে লালনের একটি গানের সঙ্গে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী। তিনি লালন ও হাসন রাজার দুটি গানের ভাবার্থ নিয়ে আলোচনার সূত্রে লিখেছিলেন—'লালন সাঁইয়ের মতো হাসন রাজাকে নিয়েও ভিন্নমত আছে—আছে নানা কিংবদন্তি। হাসন রাজার মত ও পথ নিয়েও বিতর্ক আছে। তিনি বাউল না সুফী, নিরীশ্বরবাদী না সর্বেশ্বরবাদী—এসব কূটতর্কের মীমাংসা সহজ নয়। তবে এসব তর্ক ছাপিয়ে হাসনের বড় পরিচয় সঙ্গীতকার হিসেবে—মরমি কবি হিসেবে। সঙ্গীতই ছিল তাঁর জীবনবেদ।'

হাসন রাজার গানে 'মাটির পিঞ্জিরা', 'মন-মনিয়া', 'লাল', 'ধলা', 'বন্দী' শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। এগুলোর নিগূঢ় অর্থ ভিন্ন। তিনি তাঁর পূর্বসুরি লালনের মতোই সাধনার নিগূঢ় তত্ত্বগুলো রূপকতার আশ্রয় নিয়ে সার্থকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে সাধারণভাবে হাসন রাজার গানগুলো লক্ষ করলে ওই ব্যাপারটা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। আর এখানেই তাঁর সফলতা। 'ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায় ও সুরের দরদে' হাসন রাজার গান সবাইকে মুগ্ধ করে।

তাঁর গানের তাত্ত্বিকতার মতন হাসন রাজার ব্যক্তি চরিত্রও ছিল আকষর্ণীয়, বহুবর্ণিল। তার কিছু চিত্র আমরা পাই প্রভাতকুমার শর্মার 'মরমি কবি হাসন রাজা' শিরোনামের লেখায়। তিনি লিখেছেন, 'উদারতা হাসন রাজা সাহেবের একটি বিশিষ্ট গুণ ছিল। মল্লিকপুরের জমিদার গোবিন্দবাবুর সঙ্গে জমিদারী লইয়া তাঁহার বিবাদের অন্ত ছিল না। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যের অভাব ছিল না। আদালতে মোকদ্দমা হইতেছে, এদিকে দুইজনে বসিয়া খোশগল্প করিতেছেন—এই প্রকার কথা আমরা শুনিয়াছি। উত্তরকালে গোবিন্দবাবুর অবস্থা খারাপ হইয়া পড়িলে তিনি তাঁহাকে সাহায্যও করিয়াছিলেন। মহাভারতে পড়িয়াছি দিনে যুদ্ধ হইত রাত্রে একদল গিয়া অপর দলের নিকট মন্ত্রণা চাহিতেন। এখানেও আমরা সেই জাতীয় একটি জিনিস দেখিতে পাই।' হাসন রাজা জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পূর্বপুরুষদের রীতি তিনিও পরিত্যাগ করতে পারেননি।

হাসন রাজার কোড়া পাখি শিকার কিংবা নারীদের প্রতি ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু তাঁর গান নিয়ে কোনো মতবিরোধ কিংবা সমালোচনা নেই বললেই চলে। এটা অন্তত প্রত্যেকেই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, তাঁর গানগুলো বাঙালির সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে। এসব গান আমাদের সত্তাকে নাড়া দেয়, অনুপ্রাণিত করে। জমিদার বংশের চাকচিক্যময় জীবনযাপনের মোহ ত্যাগ করে যেভাবে হাসন রাজা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে জীবনকে উপলব্ধি করেছেন—সেটা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।

তাঁর গানের প্রেমে পড়ি সেই ছোটবেলা থেকে। তখন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শাহীদ আলী পাবলিক পাইলট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তাম। কালীপদ রায় নামে আমাদের এক বড় ভাই বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে একটা গান বার বার গাইতেন। এই গানটি তখন এত বেশি শুনেছি যে—আমি ও আমার বন্ধুবান্ধবেরা প্রায় সবাই ওই গানটি মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। হাঁটতে, বসতে, খেলতে প্রায় আমরা হাসন রাজার এই গানটি গুনগুন করে গাইতাম—'আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে / আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে / কাজল কোঠা ঘরের মাঝে, বসিয়াছে কালিয়া / দেখিয়া প্রেমের আগুন উঠিল জ্বালিয়া / কিবা শোভা ধরে (ওরে) রূপে দেখতে চমত্কার / (আরে) বলা নাহি যায় বন্ধের রূপের বাহার / ঝলমল ঝলমল করে (ওরে) রূপে বিজলীর আকার / মনুষ্যের কি শক্তি আছে, চক্ষু ধরিবার / হাসন রাজায় রূপ দেখিলা, হইয়া ফানাফিল্লা / হু হু হু হু ইয়াহু, ইয়াহু, বল আল্লা আল্লা।'

পরবর্তী সময়ে যখন কলেজে ভর্তি হই তখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিল্পীর মুখে হাসন রাজার একাধিক গান শুনেছি। আরও পরে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে হাসন রাজার গান শুনে কত যে রাত কাটিয়েছি, তার সঠিক হিসাব নেই। আমার শোনা অসংখ্য গানের মধ্যে একটি গানের কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। অন্য অনেকের মতো এই গানটি আমি যতবার শুনেছি, ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। সুর আর কথার কী অপূর্ব সম্মিলন! শুনলেই মন আনচান করে—'লোকে বলে, লোকে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার / কি ঘর বানাইব আমি শুন্যের মাঝার / ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর / আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার / এই ভাবিয়া হাসন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে / কোথায় নিয়া রাখবা আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে / হাসন রাজায় বুঝতো যদি বাঁচব কতদিন।/ দালানকোঠা বানাইত করিয়া রঙিন।'

'লোকে বলে, লোকে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার' গানটি প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ একটি জাতীয় দৈনিকে 'বাউলা কে বানাইলো রে' শিরোনামে এক লেখায় লিখেছিলেন—''হাসন রাজার বিখ্যাত গান লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমায়'' শুনলে কারও কারও তাঁর ঘরবাড়ি দেখার ইচ্ছা হতে পারে। এমন কিছু মানুষ গেলেন হাসন রাজার ঘরবাড়ি দেখতে। হাসন রাজা নিজেই আগ্রহী হয়ে তাদের ঘরবাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। নিজের কবরের জায়গা দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন আমার বাড়ি। ঘটনা কতটুকু সত্যি জানি না। প্রভাতকুমার শর্মার লেখা মরমি কবি হাসন রাজায় এ রকম পড়েছি। সুনামগঞ্জে গিয়ে সেই বিখ্যাত 'ঘর' দেখেও এসেছি।' সৈয়দ মুর্তাজা আলী হাসন রাজাকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি এক লেখায় লিখেছিলেন—'আমার ছেলেবেলায়—এই শতাব্দীর প্রথম দশকে—পিতার সঙ্গে হাসন রাজার বাড়ি গিয়েছি। তাঁর ঘরবাড়ি তাঁর সঙ্গতি অনুযায়ী সুগঠিত বা সুদৃশ্য ছিল না। আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁর বৈঠকখানার সংলগ্ন ছিল ঘোড়ার আস্তাবল। বৈঠকখানায় আসবাবপত্রের বাহুল্য ছিল না। এই কারণে কেউ কেউ তাঁর বাসগৃহ তাঁর বিত্তবৈভবের যোগ্য নয় বলে অনুযোগ করলে তিনি তাঁর সরল অনবদ্য ভাষায় বলেন—'লোকে বলে, বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার...।' তিনি আরও লিখেছিলেন—'আমি তাঁকে (হাসন রাজা) দেখেছি সুনামগঞ্জ বাজারে। তিনি জমকালো জরি ও মখমলের পোষাক পরে ভ্রমণে বের হতেন। তাঁর বর্ণ ছিল তপ্ত কাঞ্চনসদৃশ। দীর্ঘ আয়ত চক্ষু, উন্নত নাসিকা ও প্রশস্ত ললাট তাঁর বদনমণ্ডলের শোভা বর্ধন করত।' এই লেখা সৈয়দ মুর্তাজা আলী সম্ভবত ১৯৭৭ সালে লিখেছিলেন। সেটা বেশ আগের লেখা। কিন্তু তাতে কী? এখনও সেই চিত্র গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় কিংবা কোনো কোনো অঞ্চলে তারচেয়েও বেশি। এখনো পল্লিগ্রামের মানুষ রাত জেগে নতুন প্রজন্মের বাউল-গায়কদের কণ্ঠে হাসন রাজার গান শুনে বিমুগ্ধ হচ্ছেন। এই তো সেদিন, ২০১২ সালের ৫ থেকে ৭ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ শহরের বালুর মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো হাসন রাজা লোক উত্সব। সেই উত্সবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সঙ্গীত শিল্পী ও অনুরাগীরা জড়ো হয়েছিলেন। আর হাজারো মানুষ টানা তিন দিন উপভোগ করেন হাসন রাজার গান।

হাসন রাজার গানের প্রেমে পড়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন সময় সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন। 'হাসন রাজার বাড়ি' শিরোনামে লিখেছেন একটি কবিতাও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাসন রাজার উদ্দেশে প্রশ্ন করেছিলেন, 'কও তো হাসন রাজা, কি বৃত্তান্তে বানাইলে হে মনোহর বাড়ি?' কিন্তু আমি বলি—একজন জমিদার হয়েও তাঁর এত পরিবর্তন হয়েছিল কেন?—সেটাই বরং ভাবনার বিষয়।

লেখা: সুমন কুমার দাশ
সূত্র: প্রথম আলো

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: editordailymail@gmail.com, newsroom.dailymail@gmail.com