পুস্তক: হাসনরাজা ও তাঁর সাধনা
সমাজ চেতনা ও রাজনৈতিক ভাবনা
 প্রকাশিত: 
 ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০১:৪৪
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৪:৩৬
                                
হাসন রাজা পিতৃবাস রামপাশা কৌড়িয়া পরগনার অন্তর্ভূক্ত এই রামপাশাকেই তিনি তার আদি ও আসল নিবাস মনে করতেন। মৃত্যুর পাঁচ ছয় বছর পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রত্যেক শীতকালে অন্ততঃ তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত রামপাশাতে কাটাতেন। আর ‘সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) অন্তর্গত জন্মভূমি কবির আবাল্যের একটি স্থান লক্ষণশ্রী । 
তার গানে আবৃত্ত দশমিক অংকের মতো বারবার ঘুরে ফিওে আসে রামপাশা ও লক্ষণশ্রীর নাম। সেজন্যেই লক্ষ্যনীয় যে, প্রজাহিতৈষী হাসন রাজা বারবার মানুষের মধ্যে ছুটে গেছেন, তাদের সুখ দুঃখ উপলদ্ধি করতে। প্রজার কষ্টে কষ্ট, তাদেও আনন্দে আনন্দ। মরমী কবি হাসন রাজা তার হৃদয় উৎসারিত কালজয়ী পঙ্ক্তিমালার জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত। তিনি তাঁর নিজ পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
হাসন রাজা মইরা যাইব না-পুরিতে আশা
লক্ষèণশিরির জমিদারী বাড়ি রামপাশা।
মরমি কবি হাসন রাজা কত অসংখ্যবার কেবল মানব সেবাই করেননি, তিনি জীবসেবা করেছেন এই লক্ষনশ্রীর বাড়ি থেকে। এই বাড়ির বৈটকখানায় বসে তিনি শত শত গান আর সুরের ধ্বনি সৃষ্টি করেছিলেন। পুত্র গনিউর রাজা জানান- ‘তাঁর তখন বয়স মাত্র চব্বিশ কি পঁচিশ। একদিন রাত্রের প্রথমার্ধে তিনি তাঁদের বাড়ির বাইরের ঘরের বৈঠকখানার নিকটবর্তী হওয়াতে দেখতে পেলেন তাঁর পিতাসাহেব সামনের বারান্দাখানার মধ্যখানে বসে আছেন, আর তাঁরই চারপাশে ২৫ থেকে ৩০ জন ভক্ত মহিলা ও পুরুষ একত্রে জড়ো হয়ে একটি মরমি গান গাচ্ছে। তাদের মধ্যখানে একটি চেয়ারে বসে তাঁর পিতাসাহেব (হাসন রাজা) গানের তালে তালে মাথা দুলাচ্ছেন। গনিউর ভালোভাবে তাঁর দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, তাঁর দু’গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা বইছে। গনিউর রাজা এরকম দৃশ্য নিজের চক্ষে দেখে সেদিন অবাকই হয়েছিলেন।
২.
কবি হাসন রাজার শেষ জীবনের উপলদ্ধি অনেকটা টলষ্টয়ের মত ছিল। অসংখ্য সহায়-সম্পত্তি দান খয়রাত করার পরও তার শেষ জীবনের আকাঙ্খা জমিদারী বিষয়াদি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা, হতদরিদ্র মানুষের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া। জানা যায় হাসন রাজার সহায় সম্পদের প্রায় ষাট সত্তর ভাগই সিলেটে এবং বিশ্বনাথ এলাকার আশপাশে ছিল। কিন্তু তার জীবনের শেষ দিকে তিনি এ সম্পত্তিকে ওয়াকফ করে বৃহত্তর স্বার্থে রেখে যান। শোনা যায় এই ওয়াকফটি আংশিকভাবে এখনও বলবৎ রয়েছে।
তিনি ভালোভাবেই জানতেন রঙিন দালান কোঠার জীবন বেশিদিনের নয়। এই অতিব নশ্বর রঙের মেলায় তার নিজের নামগন্ধ পরিচয় একদিন হারিয়ে যাবে। তাই তার একমাত্র চাওয়া যেন চোখ মুজলেই তিনি তার উজ্জ্বল আলোকিত প্রিয়ার মুখ দেখতে পান। 
হাসন রাজার এই আত্মানুভূতি এবং পরমাত্মানুভূতি দুই মিশিয়ে এক উচ্চানুভূতিতে উপনিত হয়েছিল। ঘরবাড়ি ছিল যেনো তার মনস্থাত্মিক নিদর্শন। প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত এই বাড়ির বাস্তব বর্ননা দিয়েছেন- ‘সুনামগঞ্জ শহরের লাগোয়া পশ্চিমে লক্ষণছিরি বা লক্ষণশ্রী গ্রামে (বর্তমান তেঘরিয়া গ্রাম) সুরমা নদীর দক্ষিণ দিকের তীরে ছিল হাসন রাজা সাহেবের ভদ্রাসন। কিন্তু তার বাড়ি দেখলে কে বলবে সেটা কোন জমিদারের বাড়ি? না দালানকোঠা, না পাকা ঘরদোর! পল্লী গ্রামের সাধারণ গৃহস্থবাড়ির মত তারও ছিল মাটির ঘর, খড়ের চাল, কোনটা বা ঢেউটিনের। তফাতের মধ্যে এই যে, ঘরগুলো ছিল বড় আকারের আর সংখ্যায় অনেকগুলো। ঘরের বৈঠকখানার চেহারাও ছিল তথৈবচ, আসবাবপত্রের মধ্যে একখানা সাধারণ তক্তপোষ, তার উপরে ছেঁড়া পাতার শীতলপাটি বা জীর্ণ মলিন শতরঞ্চি, খানকয়েক নড়বড়ে চেয়ার, বেঞ্চি, টুল, টেবিল ইত্যাদি। সব মিলিয়ে যেন দীন দশার চেহারা, জমিদারবাড়ির কোনো জলুসের ছাপ ছিল না ঘরে বা ঘরের আসবাবপত্রে। কিন্তু পরিবশেটি ছিল মনোরম। বৈঠকখানার সামনেই পূর্বদিকে খোলা মাঠের মত উঠোন আর উত্তরদিকে সুরমা নদীর অবাধ জলস্রোত।’
১৮৭১ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল এই সময়ের মধ্যে তার বড় ভাই উবায়দুর রাজা, বাবা আলী রাজা এবং আরেক ভাই মুজাফ্ফর রাজা এই তিন জন পরলোকে পাড়ি জমান।
৩.
পাঁচ লক্ষ একরেরও বেশি জায়গা সম্পত্তির বিস্তৃতি ছিল সুনামগঞ্জ, বিশ্বনাথ, সিলেট, ছাতক, ফেঞ্চুগঞ্জ, মৌলভিবাজার ও করিমগঞ্জজুড়ে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরগনাগুলো ছিল লক্ষণশ্রী, অচিন্তপুর, লাউর, পাগলা, পলাস, বেতাল, জফরগড়, কৌড়িয়া, গয়ার, বাজুবন, চামতলা, মহারাম, কুড়–য়া, আম্বরখানা, সওদাগড় টিলা, টিলাগড় এবং সিলেটের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকাজুড়ে। হাসন রাজার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত ছিল অসংখ্য নাম না জানা জায়গা। শুধুমাত্র রামপাশা জমিদারীর অধীন ছিল বিশ্বনাথ এলাকায় ১৮৯ টি মৌজায় বিস্তৃত ৩ লক্ষ ১৯ হাজার একর ভূমি। তার এই রামপাশার সহায় সম্পদের নিরিখ করলে দেখা যায় যে ১০১টি মৌজা নিলামের পর বাকি যে ভূসম্পত্তি ছিল তার বাৎসরিক আয়ের মূল্য ছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। 
গনিউর রাজা থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র রামপাশা ও সিলেটের সহায় সম্পদ থেকে তার আয়ের পরিমাণ ছিল ৫ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে সুনামগঞ্জের জলমহালগুলো যদি ধরা যায় তাহলে ভূমি ও জলমহালের আয়সহ সর্বমোট তার প্রায় ৮ লক্ষ টাকার মতো বাৎসরিক আয় ছিল তখনকার যুগে।
অনেক পতিত ভূমি এবং হাওরও কৌড়িয়া, গয়ার ও বাজুবনের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তেমনি দক্ষিণ পশ্চিম সিলেটজুড়ে পুরনো সুরমার মরা-গাঙ্গ অববাহিকা ধরে বেশ কয়েকটি জলাশয় এলাকা, বিশ্বনাথ থানার চাউলধনী বিল, নইলা বিল ও কড়ইআইল, সুনামগঞ্জের ঝাওয়া, রওয়া, বাওন, হাফেরধারা, শিয়ালমারা, শনি, আহসনমারা, দেখার হাওর, কাঙ্গলার হাওর, টাংগুয়ার হাওড়ের অংশবিশেষসহ অনেক ছোট বড় বিল-ঝিল নদী উল্লেযোগ্যভাবে আলী রাজা এবং তার পুত্র হাসন রাজার জমিদারীর অন্তর্ভূক্ত ছিল।
সিলেটে আরেক বৈমাত্রেয় ভাই মোজাফ্ফর রাজা ১৮৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় সেখানেও হাসন রাজা জায়গা সম্পত্তি লাভ করেন। 
হাসন রাজার সহায়সম্পত্তির বিলুপ্তির পথে যায় বিভিন্ন কারনে। আজরফ সাহেবের মতে - ‘তার পিতা ও জেষ্ঠ্য ভ্রাতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুধার্ত হাঙ্গরের মত মহাজনদের বন্ধকী গ্রাস, পৈত্রিক সম্পত্তি নীলামে চড়ানো, লক্ষণশ্রী পরগনাস্থিত তার নিজেস্ব সম্পত্তির কোনো কোনো মৌজা বিক্রয়, বনেদি পৈত্রিক সম্পত্তির রামপাশা ও তার আশপাশের মৌজা রক্ষার্থে জফরগড়ের সমস্ত সম্পত্তি মৌলভি আলী আমজদ সাহেবের কাছে বিক্রি, সম্পত্তির একটি বৃহত্তম অংশ তিনি নিজে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানে দান করা, যেমন; মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, ঈদগাহ, কবরস্থান, মন্দির, উপাসনালয় এবং শশ্বান, আবার বয়স্কালে এর এক বিরাট অংশ ওয়াকফ করে গরীব দুস্তদের উপকার্থে সমর্পন এবং বিভিন্ন দুর্যোগে জনগনকে সহায়তার প্রয়োজনে সরকারকেও প্রচুর অর্থ সাহায্য, স্থাণীয় উন্নয়ন কাটামো তৈরীতে হাসন রাজার ভূমিদান। যেমন, সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল, সুনামগঞ্জ থানা, সুনামগঞ্জ স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন, পুরান হাসপাতালের জায়গা, জেলখানার জায়গা, মহকুমা প্রশাসকের (বর্তমান ডিসি’র) বাংলোঘর ইত্যাদি। হাসন রাজার এক প্রতিশ্রুতি পুরনে তাঁর ‘মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রগন সুনামগঞ্জে প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের (চৎবংনুঃবৎরধহ ঈযঁৎপয) শাখা প্রতিষ্ঠার জন্যে বিস্তর ভূমি বিনা নজারানায় দান করেছেন। কিংবা পরবর্তীকালে সুনামগঞ্জ কলেজের বর্তমান নুতন অবস্থান স্থানান্তরে হাসন রাজার পূর্ব-নির্দেশ অনুযায়ী আপ্তাবুর রাজার প্রতিশ্রƒতি পুরনে তদ্বীয় পুত্র দেওয়ান আনোয়ার রাজা চার (৪) একর বিশ(২০)শতাংশের জায়গাটুকু হস্থান্তর সম্পাদন করেন।
তাঁর দান অতি গোপনে সম্পন্ন হত। অনেকসময় গ্রহীতা বাড়ীর বাইর না হওয়া পর্যন্ত তাঁর যাচনা যে আশাতীত ফলবতী হয়েছে তা জানতে পারত না। তিনি লোকের মুখে আত্ম-প্রশংসা শুনতে ভালোবাসতেন না। তাই যা দান করতেন, তা যেন তাঁর সম্মূখে প্রকাশ না পায় তাঁর ব্যবস্থা করতেন। তিনি তাঁর গুরুকে (মুর্শিদ) হাতী পর্যন্ত দান করেছিলেন। দরিদ্র, দুর্ভিক্ষপীড়িত, কন্যাদায়গ্রস্থ কেউ কখনো তাঁর কাছে থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরেনি। 
চিরদিনই অন্যায় অবিচারে আপোষহীন ছিলেন। ‘অন্যায়কে তিনি কখনও সহ্য করতে পারতেন না। হিন্দু হোক কি মুসলিম হোক, যে কেউ অন্যায় আচরণ করলে তাকে প্রত্যক্ষে কিংবা পরোক্ষ শাস্তি দিতেন।’
নানাবিদ অহিংস কৌশল অবলম্বন করে তিনি তার প্রজাদের মন জয় করতেও সমর্থ হন। একবার হাসন রাজা রামপাশায় প্রজা বিদ্রোহের খবর পেয়ে লক্ষণশ্রী হতে ঘোড়ায় লোকজনসহ রওয়ানা দিলেন। মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন এক স্থানে কতগুলো বিড়ালের বাচ্চা পড়ে আছে। অসহায় এই শাবকগুলো দেখে তার মনে করুণার সঞ্চার হলো। নিকটবর্তী এক বাড়িতে পৌঁছে গৃহস্থের হাতে ১০টি টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন- ‘তুমি, এই বাচ্চাগুলোকে লালন পালন কর, বাকি যা খরচ হয়, আমার কাছ থেকে নিও।’এই খবর শুনে রামপাশার বিদ্রোহী প্রজাদের মন একদম নরম হয়ে যায়। তারা ভাবল, এমন দয়ালু লোকের সঙ্গে কোনো বিবাদ চলে না। আর সেই দিনই তারা বিদ্রোহের কথা ভুলে গিয়ে বাকি খাজনা পরিশোধ করে দেয়। এরপর এও জানা যায়, যে পরিবারটিতে বিড়ালের বাচ্চাগুলো স্থান পেয়েছিল, হাসন রাজা তাদেরকে অনেক জায়গা জমি দান করেন। এইভাবে রামপাশার জমিদারির অধীন প্রজাবিদ্রোহের পরিস্থিতি প্রশমিত হয়। 
বিরোধীদের শত্রুতা ছাপিয়ে হাসন রাজা কিন্তু নিজের একটি আকর্ষণীয় জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার জমিদারীর ভিতর বিভিন্ন এলাকাধীন জমিদারিত্ব আরও সক্রীয় করে তোলার লক্ষ্যে কাচারিঘরসমূহ মেরামত করিয়ে প্রজাসকলের আরও কাছাকাছি পৌঁছেন এবং বিশ্বস্থতা অর্জন করেন। শুধুমাত্র খাজনা আদায়ের জন্যে নয়, বরঞ্চ জনকল্যাণ ও চাষাবাদ উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজ হাতে কর্মচারী নিয়োগ করতেন। বাবা ভাইয়ের সময়কালীন সমস্ত কর্মচারীগণকে তিনি পূনর্নিয়োগ করেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ‘হাসন রাজা’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, ‘সুনামগঞ্জের সকল জমিদার একবার সম্মিলিতভাবে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে তার কাছে যেয়ে তাদের মনের কথা ব্যক্ত করেন। তিনিও তাতে সায় দিয়ে বলেন তথাস্তু, তবে তা গঠনের শর্তাদি আগে তাঁকে পড়ে শোনাতে হবে। এ ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ভালো মানুষকে পরিচালক নিযুক্ত করতে হবে। উদ্যোক্তাগণও তথাস্তু বলে তার কাছ থেকে বিদায় নেন। মাস খানেক পর স্মারকলিপি ও বিধি বিধানসহ উপস্থিত হলে, তিনি মাহফুজ আলী মোক্তার সাহেবকে ডেকে এনে এগুলো তাকে বাংলাতে বুঝিয়ে দিতে বলেন। তিনি তখন পাঠ করে বাংলা ভাষায় ব্যাখ্যা করলে দেখা গেল- কয়েকজন স্বার্থপর জমিদার তাদের আপনজনের মধ্যে এ ব্যাংক পরিচালনার ভার সীমিত করেছেন। এতে এদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে দেখে তিনি এদের সম্বর্ধনার জন্য এমন এক অদ্ভূত আয়োজন করতে তার খানসামাদের আহ্বান করলেন- যাতে বাধ্য হয়েই তারা অন্তর্ধান করলেন এবং ব্যাংক গঠনের আশা চিরতরে বিসর্জন দিলেন।’
রামপাশায় বাবু কালীপ্রসন্ন দেবকে প্রধান নায়েব হিসেবে নিযুক্ত করে নিকটবর্তী বিশ্বনাথ বাজারকে থানা হিসেবে উন্নিত করার জন্যে এক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এতে অবশ্য পার্শবর্তী জমিদারগণ মিলিতভাবে সরকারের কাছে আবেদনপত্র পাঠান। ফলশ্রুতিতে তখন এক সাবরেজিস্ট্রি অফিস স্থাপিত হয় এবং সেটিই আজ বিশ্বনাথ থানা তথা উপজেলা।
৪.
হাসন রাজা সবসময় তাড়িত ছিলেন সমাজবোধ দ্বারা। বিপন্ন অথবা ঐশর্য্যময় অবস্থা কিছুই তাকে পশ্চাদপদ মূঢ জনসাধারণের কাছ থেকে সরিয়ে রাখেনি। দারিদ্রই একমাত্র রোগ নয়, সবচেয়ে গুরুতর ব্যাধি সমাজবোধের অভাব। অর্থের দুর্নিবার আকর্ষণের কারনে দারিদ্রতা বেড়ে যায় না বরং লোভের কারনে। হাসন রাজা এই লোভ লালসাকে অবজ্ঞা করে চেয়েছেন তাঁর নিস্বার্থ নৈতিক বাণী পৌঁছে দিতে। ভাবজগতে কিংবা মরমি সংগীত জগতের বাইরে হাসন রাজার কোনো রাজনৈতিক চিন্তাধারা অথবা রাজনৈতিক সচেতনতা ধরা না দিলেও তার বাস্তব জীবন বিশ্লেষণ করলে তার কিছুটা আঁচ করা সম্ভব। হাসন রাজার জীবনের চলাফেরা বা তার ভাবভঙ্গিতে যে জিনিসগুলো পরিস্কারভাবে ধরা পড়েছে তার সবগুলো তার বংশধরগণ ও প্রতিবেশীদের কাছে অজানা নয়।
হাসন রাজার কনিষ্ট পুত্র দেওয়ান আফ্তাবুর রাজার বরাত দিয়ে জানা যায়, হাসন রাজা একটি অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী ছিলেন। সর্বভারতজুড়ে হিন্দু মুসলমানের মাঝে একটি নাড়ির বন্ধন খুঁজে নিতে তিনি উৎসুক ছিলেন। সারা ভারত এক থাকুক তা-ই তাঁর কাম্য ছিল। বেআইনীভাবে ভারতকে শাষনশোষনের কারনে তিনি ইংরেজবিদ্বেষী ছিলেন। কিন্তু উন্নয়নের খাতিরে তিনি স্থানীয় ইংরেজ প্রশাষনকেও সহায়তা করেছেন তাও আমরা আগেই জেনেছি।
হাসন রাজা একাধারে যেমন অসংখ্য স্থানীয় সৎ ভদ্রলোকের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন ঠিক তেমনি অতি সাদামাটা গ্রাম্য অশিক্ষিত জনসাধারণের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তাঁর শেষ সময়কালে সুনামগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সর্বজনাব মফিজুর রহমান, যিনি দীর্ঘকাল সততার উজ্জল আদর্শ প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি বয়োবৃদ্ধ হাসন রাজাকে অত্যন্ত মান্য করতেন এবং প্রায়ই তেঘরিয়ার হাসন রাজা বাড়িতে যাতায়াত করতেন। উল্লেখ্য তিনি বাংলাদেশের বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানি সাহেবের পিতা। 
অতি সাধারনের মধ্যে দিলারাম, খতিজান, বুধাই, সায়েদ, কবুতরী, আহাদ প্রমুখ যাদের কাছ থেকে হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক তথ্যেরও সন্ধান মিলেছিল একসময়। এর উপর ভিত্তি করে অনুমান করা যায় তাঁর মাঝে চেতনা-লদ্ধ নিজস্ব রাজনৈতিক মতের একটি সন্ধান মিলে। তার সময় সমাজে শত ঘাত প্রতিঘাতের খেলা চলছিল আর সেই সংঘাতময় পরিবেশে বাস করেও তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক জ্ঞানের নিভৃতে বাস্তব জীবনমুখী মত ও পথ বাতলে নিয়েছিলেন। এই মত ও পথের মাঝে ছিল প্রধানত দু’টি দিক ছিল- ১. সাম্য এবং ২. নিস্বার্থপরতা। 
হাসন রাজার মধ্যে সর্বাধিকভাবে মরমী ভাবধারাই অটুট থাকলেও সাম্য ও নিস্বার্থ চিন্তা-চেতনার বিকিরণে তার চলাফেরায় ও বাস্তব জীবনে একটি রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে। ১৮৪৮ সালের মার্কস এঙ্গলসের প্রকাশিত ‘কমিউনিষ্ট মেনিফেস্টো’র মূল ভিত্তি ছিল- মানব ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামে লিপ্ত এবং তার সবকিছু একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে যেদিন প্রলেটারিয়েট বা সর্ব-জনসাধারণের বিজয় ঘটবে। কিন্তু মার্কস তার এই তত্ত্বে কোন নৈতিক সমাধান দিতে পারেননি। মার্কসের এই ঈর্ষা-বিদ্বেষময় শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের খবরটি হাসন রাজার কাছে এসে পৌঁছেছিল কিনা আমরা তা জানি না, তবে তার জীবনচলার পথ থেকে ঐটুকু জানা যায় যে, মার্কসের সাম্যের মূলমন্ত্রটি তার মনে শতস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হয়েছিল।
১৯১৭ সালের রাশিয়ার বলশেভিক যুগের সাম্যবাদের বিপ্লবী চেতনা হাসন রাজাকে হয়তো ধাক্কা দিবার আগেই (তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পূর্বে) তার ঐতিহ্যবাহী ক্রিয়াশীল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় নীতিবোধগুলো এবং ইসলামের উজ্জল সাম্যবাদী স্তম্ভগুলো তাকে নিশ্চয় ভাবিয়ে তুলেছিল। হাসন রাজা যে সাম্যের জীবনে ডুব দিয়েছিলেন তা তার জীবনের নানাক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। 
‘সকল মানুষ ভাই ভাই’ তার এই চিন্তাধারাটি আরো দশজন জমিদার, অর্থবান, ব্যবসায়ী কিংবা প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে যে একেবারেই অনুপস্থিত অর্থাৎ এই চিন্তাধারার পূর্বশর্ত হিসাবে নিস্বার্থপরতা যে তাদের মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত- তা তিনি প্রখরভাবে অনুভব করতেন। বরঞ্চ বাস্তবজীবনে দেখেছিলেন হিংসা, বিদ্বেষ, সংকীর্নতা আর কুপ্রবৃত্তি। কিন্তু তা সত্তেও হাসন রাজা নিজের জীবনপথে ও গানচর্চার মাঝে ফলাও করেছেন সাম্য-চিন্তাধারার আদর্শকে। 
বিংশ শতাব্দির প্রথমদিকে হাসন রাজা ব্রহ্মচারী অনুশীলনকারীদের মাঝে যে চিন্তা-পথের দিক দেখেছিলেন সেই অনুশীলনে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ছিল ঠিকই কিন্তু সর্বসাধারণকে বাদ দিয়ে, তাদের পাশে না গিয়ে, তাদের সংস্কৃতির মধ্যে প্রবিষ্ট না হয়ে এ যে একেবারে অকেজো তা তিনি ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাঁর নিজের সহোদরকে লক্ষ্য করে। তার সহোদর মোজাফ্ফর রাজা সিলেটে একজন ব্রম্মচারবাদী ছিলেন। এই ঘাতপ্রতিঘাতের মাঝেই হাসন রাজার নবায়ন ঘটেছে। পরিশুদ্ধ হয়েছেন নিজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষরূপে’, লালনের ‘রতনরূপে’ কিংবা তার নিজের কথায় ‘হাসনজানরূপে’।
১৯২০ সালে হাসন রাজা বেশ অসুস্থ অবস্থায়। তখন তার সাধ্য ছিল না যে ঘুরে বেড়ানোর বা কোনজায়গায় যাতায়াত করার। অসুখে হাসন রাজার শারিরীক অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে সিলেটে চিকিৎসার জন্যে তিনি বাধ্য হয়ে একই বছরের শেষের দিকে। সারা ভারত জুড়ে তখন অখন্ড ভারতের পক্ষে-বিপক্ষে যখন একটি জন গুঞ্জরন শুরু হয়, সেই সময় হাসন রাজার মধ্যে অখন্ড ভারতের জন্যে যেনো একটি মমত্ববোধ সার্বজনিন আকুতির মতো দেখা দেয় বলে পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়। তখন অসুস্থতার ভারে তার অবস্থা খুবই সূচনীয়। মুমুর্ষ রোগাক্রান্ত অবস্থায় বাধ্য হয়ে চিকিৎসার আশায় সিলেট যেতে হয় নভেম্বর মাসের পয়লাদিকে। তঁাঁর শেষ একটি বছর সুনামগঞ্জের লক্ষনশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামের বাড়িতেই কাটলো। ইংরেজী বছরের শেষ-প্রান্তে ১১ অগ্রাহায়ন ১৩২৯ বাংলায় আমাদের মরমি কবি হাসন রাজা এই নশ্বর পৃথিবীর মাটির পিঞ্জিরার সকল বাধনকে ছিন্নভিন্ন করে চিরতরে রওয়ানা দেন তাঁর বহু আঁকাঙ্কিত প্রেমাস্পদ একমাত্র শ্রষ্টা আল্লাহ-অভিমূখে।
৫.
হাসন রাজার গান লেখার ক্ষেত্রে তার নায়েব মুহরিদের বড় অবদানও রয়েছে। কেননা গানের পাণ্ডুলিপিতে হাসন রাজার নিজের হাতের লেখা ছাড়াও অন্যের হাতের লেখা লক্ষ্য খুজে পাওয়া যায়। তবে অন্যের হাতে লেখার চাইতে তার নিজের হাতের লেখার পরিমাণটিই অনেক বেশি বলে অনেকে মনে করেন। খুবই একনিষ্টভাবে এ বিষয়গুলো সত্যতার মানদণ্ডে দাঁড় করাতে গিয়ে একটু পরখ করে যে বস্তুনিষ্ট সত্য খুঁজে পাওয়া যায় তাতে তার গানের প্রায় ষাট ভাগ নিজের হাতের লেখা। জানা যায় হাসন রাজার কালে মোট ১১ জন নায়েব ছিলেন। আর মোহরীরা তাঁদের কাজে নিয়েজিত ছিলেন সর্বমোটে ১৬ জন। তারমধ্যে কীর্তি নারায়ণ, সুধীর কুমার, কালিপ্রসন্ন দেব, রাশিদ আলী, গগন দত্ত অন্যতম।
ছাতকের সাতপাড়া নিবাসী বাবু কীর্তি নারায়ণ গুণ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ নায়েব। তার অকাতর ও নিরলস কর্তব্যকর্ম পালন হাসন রাজার জমিদারীকে আরও অটুট রেখেছিল। লক্ষণশ্রীতে সবাই রাশিদ আলী মুহুরিকে একবাক্যে চিনতেন। ১৯২০ সালে হাসন রাজা কর্তৃক সম্পাদিত একটি দানপত্রে তার একটি সাক্ষ্য মিলে। লক্ষণশ্রীতে কিছুদিন কাজ করার পর তাঁকে কৌড়িয়ার রামপাশায় স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর প্রায় ৪১ বছর অর্থাৎ ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বপালন করেন। তার পুত্রদের মধ্যে একজন হলেন জনাব রাগিব আলী, যিনি বাংলাদেশের ও সিলেটের একজন ধনবান ব্যক্তি ও ‘দানবীর’ হিসেবে খ্যাত। 
১৯০৯ সালে যখন হাসন রাজার ৫৫ বছর বয়স। তার বন্ধু দেওয়ান মনোহর আলী, সরাইলের বিখ্যাত কুড়াশিকার-আসক্ত জমিদার একদিন পরামর্শ দিলেন ‘একজন ইংরেজ পাহারাদার নিয়োগ করুন, তাহলে দেখাবে তারা শাসক নয়।’ যেমন বলা তেমন কাজ। হাসন রাজা সাহেবের অনুরোধে মনোহর আলী সাহেবের এক ঢাকার ইংরেজ বন্ধুকে দিয়ে একজন কর্মচারী নিয়ে আসা হলো সুনামগঞ্জে। তারই ফলে এই খেয়ালের বশবর্তী হয়ে হাসন রাজা তার জীবনে ঘটালেন এক দুর্ভোগ। নামমাত্র একজন ইংরেজ বডিগার্ড নিয়োগ। বাঙালি হাসন রাজাকে কিন্তু এজন্যে অনেক খেসারত দিতে হলো। বুঝতে পারলেন তিনি স্বাধীন নন, তিনি পরাধীন। রবাট বি মিল নামে হাসন রাজার এই বডিগার্ড চাকুরী করার পর মিথ্যা দাবী করে বসলো সে হাসন রাজার ম্যানেজার বা নায়েব। তাতে সে হাসন রাজার উপর একটি মিথ্যা মামলা টুকে দিল। শেষ পর্যন্ত সিলেটের ডি সি গর্ডন, বিচারক হেজলেট সাহেব এবং সৈয়দ সিকান্দও আলীর যৌথ প্রচেষ্টায় সেই মামলার একটি সোরাহা হল। হয়তো এই ঘটনার পরেই হাসন রাজার মধ্যে বাঙালী জাতিসত্ত¦াবোধ তাকে ঝেকে বসে। তাঁর একটা গানে শুনি -
আমি তোমার কাঙালী সুন্দরী রাধা
তোমার লাগিয়া কান্দিয়া ফিওে হাসন রাজা বাঙালী।

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: