পুস্তক: হাসনরাজা ও তাঁর সাধনা
হাসন রাজার জীবন বৈচিত্র্য
প্রকাশিত:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০১:১৫
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১২:৫২

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এবং ছবিদৃষ্টে মনে হয় হাসন রাজা ছিলেন যেনো একজন প্রকৃত রাজা। তাঁর চেহারা এমনই সুন্দর ছিল যে হাজারো লোকের মাঝে সর্বাগ্রে দৃষ্টি পড়তো তাঁর উপর। তিনি ছয় ফুট লম্বাটে দোহারা গড়নের ব্যক্তি ছিলেন, রং লালচে ফরসা যাকে গৌর বর্ন বলা হতো। সুদীর্ঘ নাসিকা, রক্তাভ আয়ত পিঙ্গল চোখ ঝলমল করার মত, মাথায় রেশমি এক ঝাকড়া চুল প্রসারিত কাধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো, বিন্যস্থ গোফ শোভিত প্রশস্ত মুখে যেনো সারাক্ষন সুদুর প্রসারী একটি গভীর চিন্তার ছাপ নিয়ে আসতো।
হাসন রাজার পোশাক পরিচ্ছদ্দ ছিল খুবই সহজ সরল । সাদা ধুতি লুংগির মত পেছিয়ে কোমড়ে বাধা থাকতো, শরীরে থাকতো একটা গেঞ্জি, তার উপরে তাঁর গলা আর কাঁধ জুড়ে বেয়ে থাকতো একখানা শাল। এই ছিল তার সচরাচর সাদাসিধা পরিচ্ছদ্দ। উৎসব-আনুষ্টানিক মুহুর্তে জরির কারুকাজ খচিত পোশাক-আশাক পরতে ভালোবাসতেন। তখন মাথায় থাকেতো চৌগা-চাপকান পাগড়ি। হাসন রাজার প্রিয় রং ছিল বেগুনি রং। তাঁর আচকানগুলোর একটি, তলোয়ার একখানা আর একটি লাটি এখনো সুনামগঞ্জে হাসন রাজা মিউজিয়ামে শুভিত আছে। ইংরেজ আমলে কখনো হাসন রাজা তাঁর জীবনে পাশ্চাত্য জগতের অর্থাৎ ইউরোপিয়ান কিংবা ব্রিটিশ পরিচ্ছদ্দ ব্যবহার করেছিলেন তা পারিবারিক অথবা অন্য কোন সুত্র থেকে সাক্ষ্য প্রমানাদি পাওয়া যায়নি। অথচ দু:খজনকভাবে অন্যান্য কৃত্রিম তথ্যের সাথে পাশ্চত্য দেশের ‘টাই’ পরছেন হাসন রাজা, তা চাষী নজরুল পরিচালিত ‘হাসন রাজা’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। হাসন রাজার পোশাকের বহর এমন ধরনের ছিলো যে কোনসময় তিনি ঋষিসূলভ রূপ ধারন করতেন আর অন্যসময় তাকে মনে হতো সুলতানী পোশাকে ভূষিত এক রাজ্যাধিরাজ।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাহেবের কথায়: হাসন রাজার ‘সত্তায় একজন সৌখিন জমিদার, একজন দাঁতা ও দয়ালু ব্যক্তি, একজন কবি ও একজন দার্শনিক এমনভাবে মিশে রয়েছিল যে, তার এক রূপের প্রকাশের পরে অন্য রূপের প্রকাশে সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হত। লাট সাহেবের দরবারে যিনি শাহানশাহী লেবাস পরে প্রথম শ্রেণিতে আসনগ্রহণ করে তার নিজের ও বংশের মানমর্যাদা রক্ষা করতেন। তিনি যখন গায়েনদের নিকটে বসে তাদের অপরাপর একজনের মত হাসি-ঠাট্টায় রত হতেন, তখন এরূপটি সকলের কাছেই আশ্চর্য বলে মনে হত।’
প্রভাতকুমার হাসন রাজার চিন্তার প্রসারতার সাথে সেই চিন্তার ভেতরকার মানুষের স্বরূপটাও তুলে ধরেছিলেন। উদারতা প্রসঙ্গে তিনি বললেন- ‘মল্লিকপুরের জমিদার গোবিন্দবাবুর সঙ্গে জমিদারী লইয়া তাহার বিবাদের অন্ত ছিল না। কিন্তু উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যের অভাব ছিলনা। আদালতে মোকাদ্দমা হইতেছে, এদিকে দু’জনে বসিয়া খোসগল্প করিতেছেন।’ পরবর্তীকালে গোবিন্দবাবুর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে তিনি তাকে সাহায্য করেন। আয়াতুল্লাহ কর্তৃক মিথ্যা মামলা প্রসঙ্গে সেই একই উদারতা দেখি। শর্মা বাড়ির কর্মচারী বুধাই এর কাছ থেকে জানতে পারেন হাসন রাজার স্বচ্ছ নির্মল মন গোড়ামি ও সংকীর্নতার উর্দ্ধে ছিলো। একজন জমিদারের বেলায় সেটি একেবারে বিশ্ময়কর ছিল।
বাড়ির প্রাচীন কর্মচারীর মুখ থেকে শোনা প্রভাতকুমার শর্মার লেখায়- “একদিন রাত্রে আমি বাজার থেকে ফিরছি। বর্ষাকাল মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আমি বাড়িতে এসে পৌছেছি, এমন সময় দেখি ঘোড়ার ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। এত রাত্রে ঘোড়ার ঘরে আলো দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। একটু অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাস করলাম; ‘কে?’ উত্তর হল; ‘আমি, এদিকে এসো’। স্বরে বুঝলাম হাসন রাজা সাহেব, আমি তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলাম। দেখি এক থাল খাবার আর এক গ্লাস জল নিয়ে সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সম্মুখে এক বৃদ্ধা, এক যুবক ও দু’টি শিশু ঘাসের উপর পড়ে আছে। এখন যায়-তখন যায় এমনি অবস্থা, অনাহারে মরমর হয়ে আছে। সাহেব বললেন, ‘আলোটা তুলে ধর।’ আমি আলো তুলে ধরলাম; তিনি তাদেরকে যত্ন সহকারে আহার করালেন এবং ঘুমাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন। কিছুদিন পরে বৃদ্ধা ও যুবকটি টাইফয়েডে মারা যায়! সেই যুবকের ছেলে দু’টি বেঁচে যায়। একটির নাম রাখা হয় মুছলিম, অন্যটির নাম মমিন। তিনি তাদেরকে লেখাপড়াও শিখিয়ে ছিলেন। মমিন মারা গেছে, মুছলিম এখনও কোথায় যেন কনস্টেবল হয়ে আছে।”
জমিদারী জটিলতার নিরসনের ক্ষেত্রে হাসন রাজার মারমুখী, অত্যাচারী কিংবা উচ্ছৃংখল ছিলেন এরকম ভাবাটা একেবারেই নিবুর্ধিতার সমান। প্রজাকুলের হৃদয় জয় করতে তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী জমিদার। তিনি এমন ছিলেন যে “ইতর প্রাণী পর্যন্ত যে তার দয়া থেকে বঞ্চিত হতো না, সে-সম্বন্ধে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। একদিন তিনি ঘোড়ায় চড়ে রামপাশা যাচ্ছিলেন। রামপাশার প্রজা তখন বিদ্রোহী। মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন, একস্থানে কতগুলো বিড়ালের বাচ্চা পড়ে আছে। অসহায় শাবকগুলো দেখে তার মনে করুণার সঞ্চার হল; তিনি তৎক্ষনাৎ ঘোড়া হতে নেমে এক এক করে শাবকগুলো কোলে তুলে নিলেন। তারপর নিকটবর্তী এক বাড়িতে পৌঁছে গৃহস্থের হাতে দশটি টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘তুমি, এই বাচ্চাগুলো পালন কর, বাকী যা খরচ হয় আমার কাছ থেকে নিয়ো।’ তার এই গল্প শুনে রামপাশার বিদ্রোহী প্রজাদের মন গলে গেল। তারা ভাবল; এমন যিনি, তার সঙ্গে কোন বিবাদ করা অনুচিত এবং সেদিনই যার যা বাকী খাজনা পরিশোধ করল।” এরপর এও জানা যায়, যে পরিবারে বিড়ালের বাচ্চাগুলো স্থান পেয়েছিল, হাসন রাজা তাদেরকে অনেক জায়গা জমি দান করেন। এইভাবে রামপাশার জমিদারীর অধীন প্রজাবিদ্রোহের পরিস্থিতি প্রশমিত হয়।
২.
হাসন রাজার পঞ্চাশর্ধো বয়স। বাবার নির্দেশে পুত্র গনিউর রাজা কয়েকটি তালুকের খাজনা আদায়ে তিন দিনের নৌকা সফরে বেরুলেন।
সুনামগঞ্জের সুরমা নদী ভাটি দিয়ে মোহনপুরের জয়নগর বাজার পৌছার আগেই এক তালুকের মড়লের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিরলো। গ্রামের লোক দলে দলে ঘাটে এসে ভিড় জমালো। এক যুবক একটি কুড়াপাখি নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হল। গনিউর রাজা ওই যুবকের পিতাকে ডাকিয়ে এনে বললেন ‘কুড়াটি কি একদিনের জন্যে ধার নেওয়া যায় কিনা? বন্য কোন কুড়া যদি হাওরের মাঝে ভাটির পথে পাওয়া যায়, তাহলে এ দিয়ে কিছু লড়াই করাবার খায়েস হয়েছে। উজান হয়ে ফিরার পথে কুড়াটিকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।’ আফজাল মড়ল উত্তরে জানালো, ‘তার পুত্র এই কুড়াটিকে অত্যন্ত সখ করে লালন পালন করেছে, সে কিছুতেই একে হাতছাড়া করতে রাজী হবে না।’ মোড়লের অপারগতার কথা জানার পর তিনি সেই ঘাটে একমুহূর্ত না থেকে নৌকা ভাসানোর জন্যে মাঝিকে নির্দেশ দিলেন। নৌকা ভাসিয়ে আরও মাইল দুয়েক ভাটিতে যাওয়ার পর তার মন নিরুৎসাহিত হল। মাঝিদের আদেশ দিলেন নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে উজান বেয়ে বাড়ি ফিরে। তেঘরিয়ার বাড়িতে ফিরে এসে পেয়াদা দিয়ে ঐ মোড়লকে একখানি নোটিস পাঠিয়ে দিলেন এই বলে যে, গত দু’বছরের বকেয়া খাজনাসহ চলতি বছরের খাজনা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে উষুল না করলে অন্যথায় আগামী এক মাসের মধ্যে জমিদার সরকার তাদের জন্যে এই বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করে দখল নেবে।
পরদিন সকালে মোড়ল ভাতিজা ইবদুত তালুকদার ও মোড়লপুত্র হাসন রাজা সাহেবের কাছে এসে হাজির। অন্য সময়ের মত তাদের অভাব অভিযোগ পেশ করে জানায় যে, গনিউর রাজা তাদেরকে উচ্ছেদ করার নোটিস দিয়েছেন। তৎক্ষনাৎ হাসন রাজা গনিউর রাজাকে ডেকে পাঠালেন এবং মোড়লকে উচ্ছেদের নোটিস দেওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। গনিউর রাজা আবেগস্বরে জানালেন, ‘বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তার ছেলের কুড়াটি যখন একদিনের জন্যেও ধার পাওয়া গেলো না তখন তাদেরকে গত তিন বছরের বকেয়া খাজনা মওকুফ করার অর্থ নেই বলে পরিশোধ করার নোটিস দেওয়া হয়েছে অন্যথায় উচ্ছেদ। হাসন রাজা তার ছেলের এই আবেগের কথা শুনে জানালেন ‘হে ঠিক করেছো, তবে এ-মোড়ল যে এতখানি নিমকহারাম হবে তা কল্পনার অতীত! তাকে আমি কত যে সাহায্য করেছি তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এরকম কাজটি করতে পারলো তা বুঝা কঠিন! যাইহোক এ বিষয়টি আমার কাছে ছেড়ে দাও। দেখি আমি কি করতে পারি।’
ওইদিন বিকালে যখন হাসন রাজা আবারো গনিউর রাজাকে উদাই মড়লের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সেখানে মোড়লপুত্রের কুড়াসহ মোড়ল ভাতিজা ইমদুত তালুকদার সঙ্গে করে আনলো আরেকটি কুড়া। কিছুক্ষনের মধ্যে উদাই মোড়লের বাড়ির পিছনের ছোট পুষ্করিনির দলায় দুটি কুড়াকেই ছেড়ে দেয়ার পর এক মহা লড়াই শুরু হয়। দেখা গেলো মোড়লপুত্রের বড় কুড়াটি হেরে গেলো। বিজয়ী কুড়াটি গনিউর রাজাকে প্রদান করে হাসন রাজা বললেন, ‘গনিউর রাজা এখন তুমি মোড়লের এই জয়ী কুড়াটিকেই রাখো!’ হাসন রাজা তখন মোড়লকে জানালেন ‘ঠিক আছে মোড়ল যাও, বাড়ি যাও। তোমার ভাইকে গিয়ে বলো, তার পুত্রের কুড়াটি কাউকে দেয়ার দরকার নেই এবং তোমাদের বাড়িঘর উচ্ছেদের নোটিস প্রত্যাহার করা হয়েছে।’ গনিউর রাজাও আনন্দমনে সেখান থেকে কুড়াটিকে নিয়ে চলে যান।
৩.
জমিদার যে রকম হয়, সে রকমটা হাছন রাজা ছিলেন না । সম্পন্ন জমিদার বলতে রাশভারি, দাম্ভিক, বদখেয়ালী, উড়নচন্ডী প্রকৃতির মেজাজ সম্পন্ন অহংবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব- কিন্তু হাছন রাজা তার ত্রিসীমানা দিয়ে ঘোরাফেরা করতেন না। জনগণের সঙ্গে, প্রজাদের সঙ্গে তিনি এমনভাবে মিশে যেতে পারতেন যে তাদের আপনজন হয়ে যেতেন। পোশাক-আশাক, আচার আচরণে তাদেরই একজন হয়ে থাকতেন। প্রজার সুখে সূখী প্রজার দু:খে দুঃখী।
১৯৬০/৬৫ সালের দিকে দিলারাম বিবি তখনও হাসন রাজার নাতি বংশের বাড়িঘরে প্রাচীন একজন কর্মচারিনী-রুপে বর্ণনা করেছেন- ‘একবার বর্ষাকালে মূষলধারে বৃষ্ঠির পর হাসন রাজার প্রশ্ন জাগে আমার প্রজাগন মাটির ঘরে এই বৃষ্ঠির দিনে কি অবস্থায় কাটাচ্ছে?’ দিলারাম জানালেন, ‘সাহেব, লোকের ছনের ঘরগুলো ছুইয়ে পানি পড়ছে আর কষ্টের মধ্যে তাদের পরিবার পরিজনকে সেখানে কাটাতে হচ্ছে।’ আদেশ দিলেন নৌকার একখানা লগগি দিয়ে তার নিজের ঘরের টুল্লিখানা ছিদ্র করে দিতে। হাসন রাজার ছনের ঘর চুইয়ে তার বিছানার উপর পানি পড়তে থাকে। বড় বাঁশের ছাতাখানা তুলে বিছানাকে পানি থেকে রক্ষা করা হয়। পরদিন নিজে লক্ষনশ্রীর প্রজাগনের ঘরগুলা ঘুরে দেখে বুঝলেন তাদের ঘরগুলার আরো করুণ অবস্থা। পানিতে ভিজে সমস্ত ঘরগুলা সপসপা। এর তিনদিন পর লক্ষনশ্রীর প্রজাগণ কাজ শেষে ঘরে ফিরে সবাই দেখতে পায় তাদের ঘরে নুতন ছাউনি লেগেছে।
হাসন রাজা তার জমিদারী এলাকার অসংখ্য দরিদ্র ও অসহায় লোকজনকে জমি ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। হাসন রাজার এই মানবকল্যানমূখী কার্যকলাপ দেখে সিলেটের স্থানীয় ব্রিটিশ সরকার প্রশংসিত করে। সাধারন মানুষের কাছে হাসন রাজার বাড়ি ছিল একান্ত আপনজনের স্থান। স্বচ্ছন্দে সেখানে তারা যাওয়া আসা করতো। হাসন রাজার প্রথম মেয়ে রওশন হোসন বানু একটি ঘটনা বর্ননা করেন, ‘ছেলেবেলায় তাদের লক্ষণশ্রীর একটা ছোট মেয়েকে চোরেরা চুির করে নিয়ে যায়। ..ঘন বাদলের দিনে ওরা স্থানীয় চোরদের আহ্বানে এসেছিলো হবিগঞ্জের মান্দারকান্দি থেকে চুরি করার উদ্দেশ্যে। স্থানীয় চোরেরা এদের পেশাগত খাতির তোয়াজ না করায় এবং চুরির ব্যাপারে কোনো সাহায্য না করায় ওদের ব্যবহারের প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরই পাড়ার এক গরীব লোকের ঘর থেকে সে-মেয়েটি চুরি করে নিয়ে যায়। তারপর এক যুগ চলে গেলো। এ দলের সর্দারের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হলো। তার কাচ্চা বাচ্চা হলো। সে-চোরের সর্দার মরে গেলো। সে গায়ের মধ্যে বেশ এক মাতব্বরনি হয়ে দেখা দিলো এবং জন্মভূমির মায়া ভুলতে পারেনি। তাই চুরি হওয়া থেকে দীর্ঘ চার যুগ পর আবার ফিরে এসেছে তার দেশকে দু’নয়ন ভরে দেখবে বলে। প্রথমে দেখা দেওয়ার পর তাকে কেউই চিনতে পারেনি। তারপর ছেলেবেলার সখি সেহেলির সঙ্গে পুরোনো দিনের কথা নিয়ে আলাপ-আলোচনা কালে তখন সকলেই উল্লসিত হয়ে বললে, ‘ও তুই শাহজান’! এসেই সে প্রথমে গেলো সাহেব বাড়িতে (হাসন রাজার বাড়ি)। তারপর গাজীর দরগায়, ফকির বাড়িতে, মোড়ল বাড়িতে। তার ছেলেবেলার সব পরিচিত স্থানে। এতে প্রমাণ হয় হাসন রাজার বাড়িটি কত প্রিয় ছিল সাধারণ মানুষের কাছে।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে জানা যায়,
ফাল্গুন মাস, একটু গরম পড়েছে। সকালে লক্ষণশ্রী থেকে রওয়ানা দিয়ে পৌছাবার সময় রামপাশার কাছেই চন্দেরগাঁও পৌছে গেলেন। একটুখানি তৃষ্ণা দেখা দিল। বেহারাকে চন্দেরগাওয়ের সোহাগ রায় চৌধুরীর বাড়ির কাছে পালকী থামাতে আদেশ দেন। পালকী থেকে নেমে চৌধুরী বাড়ির দিকে অগ্রসর হতেই সংবাদ পেয়ে সোহাগ রায় চৌধুরী দৌড়ে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে স্বাগত সম্ভাষন জানালেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসন রাজা তাঁকে এক গ্লাস পানি সরবরাহ করতে বললেন। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা চলে গেল, সোহাগ রায়ের কোনো দেখা নাই। হাসন রাজার মুখে বিরক্তির চিহ্ন। তবু ভদ্রতার খাতিরে কোনো কথা না বলেই বসে রইলেন। ঘন্টা খানেক পরে হন্তদন্ত হয়ে সোহাগ রায় একটা কাচের গ্লাসে স্ফটিক স্বচ্ছ পানি নিয়ে এসে কৈফিয়তস্বরূপ বললেন- ‘বড় দেরি হয়ে গেছে। আমাদের পুকুরের জল খুবই খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমরা পুকুরের জল জ্বাল দিয়ে খাই। তাতে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের গায়ে আর কোনো ভালো পুকুর নেই। গতিকে একটা পিতলের কলসী দিয়ে লোককে আতাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সে সেখান থেকে আসতে দেরি করায় জল দিতে দেরি হলো, বেয়াদবি মাফ করবেন দেওয়ান সাহেব।’ সমস্ত বিবরণ শুনে হাসন রাজা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন- ‘আপনাদের গাঁয়ে আর একটি পুকুরও নেই?’ সোহাগ রায় মাথা নেড়ে জানালেন না; হাসন রাজা বললেন- ‘আমি আপনাদের বৈঠকখানায় বসলাম, এই পুকুর আবার কাটিয়ে তার পানি খেয়ে তবেই রামপাশায় যাবো। যাও উদাই রামপাশায় গিয়ে সকল লোককে বল যেন তারা কোদাল, উড়া নিয়ে আসে। মালীরা রামপাশায় চলে যাও। আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা সিধা-কাঠালি পাড়াতে রোজই যাবে। আমার সঙ্গে মুক্তি ও কয়জন লোক থাকবে এবং রামপাশা থেকে রোজই তিন বেলা আমার খানা নিয়ে আসবে।’
পরের দিন এই মজে যাওয়া পুকুরেরর পানি সেচে প্রায় পাঁচশত মানুষ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খননে লিপ্ত হলেন। পরের দিন মাটি কাটার পর হঠাৎ ঈশান কোণে একটু পানির রেখা দেখা দিল। তাড়াতাড়ি সে জায়গাটা আরও গভীর করে দেবার জন্য হাসন রাজা আদেশ দিলেন। একটু পরে স্ফটিক স্বচ্ছ জল উপরে উঠতে লাগলো। সোহাগ রায় তাড়াতাড়ি তার বাগান থেকে বেল, মালতী, জবা ইত্যাদি ফুল এনে পানিতে ঢেলে নিয়ে পুজা সমার্পন করলেন। তিনি এক কলসি জল নিজ হাতে এনে হাসন রাজার জন্য তুলে আনলেন এবং গ্লাস ভরে তাঁকে পানি খেতে দিলেন। পানি খেয়েই হাসন রাজা বলেন, আমার কাজ শেষ হয়েছে ভাই। এবার আমি রামপাশায় গেলাম।’ জানা যায় এটি শুধুমাত্র সোহাগ রায়ের বাড়ির লোকের সুবিধার্থে হাসন রাজা পুকুরটি খনন করেননি, বরঞ্চ অত্র এলাকার লোকজনের পানি কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে বলেই তিনি দ্রুত এই পুকুরের খনন করিয়েছিলেন।
৪.
হাসন রাজা ছিলেন একজন উদার অসাম্প্রদায়িক সাধক কবি। সকল সম্প্রদায়ের সমন্বয় সাধন ছিলো তার জীবনের ব্রত। ভেদাভেদ ভুলে তিনি মানুষের মিলন কামনা করেছেন। তার কাব্যেও সেই ঘোষণা দিয়েছেন। তার জীবন বৈচিত্র্যে ‘হিন্দু মুসলমান দুটি ঐতিহ্যের ধারা হাসন মানসে মিলিত হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত্ব বা উপনিষদের ব্রহ্মতত্বের ভাবগুলি তার জীবন দর্শনে ছায়াপাত করেছিল। চতুর্দিকের হিন্দু সমাজ আর নিজ মুসলিম গন্ডী এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ দেখেননি হাছন রাজা। হিন্দু বংশসম্ভূত হাসন রাজার প্রপিতামহ মুসলিম ধর্মে দিক্ষীত হন, তার থেকেই হিন্দু-মুসলমানকে একত্রে সমানভাবে দেখার একটি উদার মনোভাব এই পরিবারের ঐতিহ্য ছিল।
হাসন রাজার প্রজা-প্রীতি উদার মনোভাবের কথা প্রত্যক্ষদর্শী, বংশধর ও অন্যান্যদের কাছ থেকে জানা যায় যে, হাসন রাজা প্রজার সাথে মেলামেশায় খুবই সহজ সরল ছিলেন। তিনি তার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গনে বসে নির্দিধায় লোকজনের সাথে কথা বলতেন এবং তাদের খোঁজ নিতেন। কখনো তিনি মাঠে ঘাসের উপর বসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তার এই সহজ সরল জীবন যাপনে প্রজারা মুগ্ধ হতো। তিনি হিন্দু মন্দির স্থাপনে ভূমি দান করেছিলেন। এমন কি তার ‘মায়ের শ্রাদ্ধের সময় প্রজাদেও কাছ থেকে প্রায় ১২০টি গরু লাভ করেও হিন্দুদের ধর্মসংস্কারে যাতে আঘাত না লাগে এই জন্যে একটি গরুকেও তিনি বধ করতে দেননি।’
হাসন রাজার দ্বার সবার জন্য সবসময় উন্মুক্ত ছিল। তিনি জনপ্রতিনিধি না হয়েও নিজ গুণে জনপ্রতিনিধিরও অধিক ছিলেন। তিনি তার পরিবার সদস্যগণের মাঝেও চলাফেরা আর উঠাবসার একটি সহজ অভ্যেস চালু করিয়েছিলেন যাতে হিন্দু মুসলিম খ্রিষ্টানসহ যে কোনো ধর্মাবলম্বী মুরব্বিগনকে যেন যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। সমাজ ও পরিবারে একটি সুন্দর সংহতি বজায় থাকে সেক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ নজর ছিল।
শুধু ধর্ম-নির্বিশেষে নয় জাত কুল নির্বিবাদেও হাসন রাজার সব মানুষকে সমান মর্যাদা দান করতেন। সুদুরর জয়পুরের মাড়োয়ারী মহিলার প্রতি যে মমত্ববোধ দেখিয়েছেন, অন্যদিকে সুনামগঞ্জ শহরে এবং শহরের আশপাশে খাসিয়া ও বেদে সম্প্রদায়ের পূনার্বাসনেও তাঁর আগ্রহের কমতি ছিল না। মুহম্মদ আব্দুল হাই বলেছেন. ‘নিম্নস্তরের বেদেদের সাথেও তিনি সহজভাবে মেলামেশা করতে মোটেই ভ্রুক্ষেপ করতেন না।’ সেজন্যে হয়তো পরবর্তীকালে সোনাপুর, লালপুর, ভাদেরটেক এবং আরো বিভিন্ন এলাকা-অঞ্চলে এদের আবাসস্থল গড়ে তোলার তাঁর সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
একবার রামপাশায় হাসন রাজা বেদেদের নিয়ে একটি ঘঁটনার কথা জানা যায়। রামপাশার পার্শবর্তী গ্রাম নধারের খাল ধরে যখন নইলাবিলে রেরুচ্ছিলেন হাসন রাজা তখন হঠাৎ তার কানে গেলো একটি কুড়ার আওয়াজ। হাসন রাজা বজরাটি তীরে লাগিয়ে ডাঙ্গায় উঠে পড়লেন এবং আওয়াজটি অনুস্মরণ করে একটি বেদে নৌকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। নৌকায় ছিল একটি কোড়া। বেদেরা তখন তাদের দুপুরের আহার খাচ্ছিল। তিনি কুড়া দেখবেন কি, সেখানে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই হাসন রাজার সামনে অতি সাধারণ আহার পানিভাতের একটি থালা তার সামনে তুলে ধরা হলো। হাসন রাজার পাইকপেয়াদা শঙ্কিত হয়ে জানালো ‘সাহেব এ খেতে পারবেন না, কিন্তু হাসন রাজা তাদেরকে ধমক দিয়ে সেই থালাটি হাতে নিয়ে কয়েক লোকমা ভাত মূখে পুরে দিলেন। সাথের পলকদাস বাবু বললো, সাহেব এরা বেদে জাত! কি করে আপনি এ স্পর্শ করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, এরা আর আমি যে স্বজাতি লোক। আমরা সবাই কুড়া পাখি ধরি আর তাদের লালনপালন করি।
মানবসমাজে জাতে-জাতে শ্রেনীতে-শ্রেনীতে ভেদাভেদ রয়েছে তা হাসন রাজা ভালোভাবেই জানতেন এবং সে ভেদাভেদ তিনি নিজের আচরণ দিয়ে নিরসনের চেষ্টা করতেন। হাসন রাজা ঘোষণা দিয়েছিলেন শ্রেণীহীন বিভেদহীন প্রাণভরা আলোকিত মনের মানুষেরা যদি জাতেজাতে একজাতের হয় তাহলে তার গানের মর্মার্থ সহজেই বুঝতে পারবে-
তাঁর একটি গানে আছে;
জাতে জাত মিশিয়ে যাবে
আমিত্ব না রহিবে
এক জাত হইয়া যাবে, হাসন রাজার কয়।
সিলেটের ডি,সি যখন মি: ওব্রায়েন (১৮৯৩-৯৮), সে সময়ই ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সিলেটের এক বিরাট ভূমিকম্প হয়। এর পূর্বে সিলেটে এতবড় ভূমিকম্প হয়নি। আসামের চীফ কমিশনার মি: জে, এস, কটন বড়লাট লর্ড এলগিনকে টেলিগ্রাম করেন যে, সমস্ত সিলেট ধ্বংস হয়ে গেছে। সিলেটের অনেক প্রাচীন কীর্তি একেবারে লোপ পায়। হাসন রাজার বয়স তখন ৪৩। ভূমিকম্পে লক্ষনশ্রীর বাড়ীর চারপাশ ঘেরা দেয়ালের অবশিষ্টাংশ সম্পূর্নভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর ধ্বংসাবশেষ এখনো মাটি খনন করলে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। রামপাশায়ও তাঁর বাড়ীঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে এবং বাড়ীর এলাকার চারপাশ ঘেরা দেয়ালের সামনের দিকটা এখনো কোনরকম টিকে আছে।
দেশের অন্যতম দানবীরে পরিণত হয়েও হাসন রাজা কোন সময়ই এর স্বীকৃতির প্রত্যাশী ছিলেন না। শত শত প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দান করা সত্তেও তিনি সিলেট সুনামগঞ্জে তার নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেননি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের দু:খ দুর্দশায় হাসন রাজা প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একজন অভিাভাবক হিসেবে। তার মনে এই ভাবখানা ছিল যে- এ যেনো আল্লাহ প্রদত্ত অভিসম্পাত মানুষের ওপর, তার সৃষ্টির ওপর। শুধু তাই নয় এই দুর্যোগ-দুর্দিনে মানুষের কষ্ট-ভোগান্তিতেও হাসন-মন বড় কাতর, বেদনাবিদুর হয়ে উঠতো। প্রমাণ মিলে যখন তিনি নিজে একদিকে ছুটে গিয়েছিলেন মানুষের খোঁজখবর নিতে আর তার বড় ছেলে গনিউর রাজাকে পাঠিয়েছিলেন অন্যদিকে। গনিউর রাজা পরে ১৮৯৭ সালের ঐ-রাতের বেলার অভিজ্ঞতাটি লিখেছেন এভাবে- ‘ভূমিকম্পের দিন রাত্রে বুড়িরতল হইতে হাসন-নগর হইয়া বাড়ীতে ফিরিতেছিলাম, পিতা সাহেব আমাকে খবর পাঠাইলেন আমি যেনো ঐ রাত্রেই পোদ্দার ঠাকুরের বাড়ী হইয়া খোঁজখবর নিয়া শেষে আমাদের তেঘরিয়ার বাড়িতে ফিরি। অর্থাৎ তেঘরিয়া-নিবাসী সচ্চিদানন্দ ঠাকুরের বাড়ীতে বাবার নির্দেশে সেখানে গিয়া তাহাদের খোঁজখবর নেই। ঐ সময় আশ্চর্যের বিষয় দেখি যে, জীবনের মা প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা বাউলা গান গাহিতেছিল এই বিপদকালীন সময়েও। তখনও ভূকম্পন অনুভূত হইতেছিল। হাসন রাজা যেমনি দুর্যোগের ভয়াবহতায় বিচলিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, ঠিক তেমনি উনার গানের আসরের এক নিবেদিতা প্রাণ ‘জীবনের মা’র খবরটুকু নিতেও তিনি ভুলেননি। এমন মহাপ্রাণই সকল প্রাণের স্পর্শে উদগ্রীব ও উদ্ভাসিত ছিলেন।’
৫.
হাসন রাজা যেদিন থেকে তার পিতার জমিদারী চালানোর ভার কাঁধে চাপালেন, সেদিন থেকে তিনি এলাকার বিশেষত: লক্ষনশ্রী ও রামপাশায় তথা সুনামগঞ্জ ও বিশ্বনাথ এলাকায় অসংখ্য বিচারকার্যের কর্তব্যও পালন করতে শুরু করেন। তার ন্যায়-বিচার পদ্ধতি এবং ন্যায়পূর্ন-রায়গুলার কথা শুনে দুর-দুরান্ত থেকে দলে দলে লোকজন এসে তার কাছে বিচার আচার চাইতো। একসময় বিচারের সংখ্যা অধিক হওয়াতে হাসন রাজা বিশেষ একদল ন্যায়পরায়ন কর্মচারী নিয়োগ করেন। মারাত্বক ফৌজদারী মামলাগুলো তার কাছে উত্তাপন হলে সেগুলার প্রাথমিক লিখিত জবানবন্ধী নিয়ে স্থানীয় আদালতে সৌপর্দ করা হতো।
বিচারকার্যের একটি নমুনা: একবার লক্ষনশ্রীতে হুমান আলী নামে এক গুন্ডাপ্রকৃতির লোক এলাকার দরিদ্রজনকে বলাৎকার আচরণ করা শুরু করে। এমনি অবস্থায় হাসন রাজার কাছে অভিযোগ আনা হলো। তখন তাকে সংযত হতে নির্দেশ দিয়ে বলা হলো - আবার যদি লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আসে, তাহলে তার উপর কঠিন শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। কিছুদিন পর সে এলাকার বাইরের নবাগত এক খাসিয়া মহিলাকে বলপূর্বক বিয়ে করতে চাইল। উপায়ন্ত না দেখে লোকের পরামর্শে অভিযোগটি হাসন রাজার দরবারে পেশ করলো। বাদজুম্মা দলে দলে লোকের উপস্থিতিতে সমস্ত সাক্ষ্য ও শুনানীকার্য শেষ হওয়ার পর হাসন রাজা সকলকে জানালেন ‘এই শহরে সবার মত এই খাসিয়া মহিলাও এই শহরে থাকার অধিকার রাখে। এই বলে তিনি এই খাসিয়া পরিবারকে লক্ষণশ্রী পরগনাতেই একখানি জায়গা দান করলেন।’ আর ‘হুমান আলীকে সতর্ক করার পরও যখন মানুষের উপর তার অত্যাচারী অভ্যাস পরিহার করানো গেলো না, তখন তাকে একটি শাস্তি দেয়া হলো যে আগামী এক পক্ষকালের মধ্যে সে তার বাড়িঘর বিক্রি করে সিলেটের কাউকড়াইল গ্রামে চলে যেতে হবে। অন্যথায় জমিদার সরকার তার সমস্ত বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করবে এবং তার বিরোদ্ধে আদালতে চার্জসিট দাখিল করা হবে।’
৬.
হাসন রাজা করিৎকর্মা ও সম্মানিত একজন ব্যক্তি ছিলেন। তার আয়ুর্বেদীক চিকিৎসা জ্ঞানের কথা শুনলে সত্যি শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করতে হয়। সুনামগঞ্জে চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে মানুষের হাহাকার। সেকালে আনাড়ি আন্কুড়ে চন্দ্রকুমারের মত দু’য়েকজন কবিরাজের ওপর সমস্ত অঞ্চলের চিকিৎসার দায়িত্ব নির্ভর করতে হতো। এমনি পরিস্থিতিতে অনেকেই হাসন রাজার কাছ থেকে নানান রোগ সারাবার জন্যে আয়ূর্বেদীক ঔষধ নিতেন। হাসন রাজা আয়ূর্বেদ জ্ঞান চর্চার উপর একখানি বই ‘হাছন রাজার হেকিমী চিকিৎসা শাস্ত্র’ তাঁর মৃত্যুর পর তার বড় কন্যা-সন্তান রওশন হোসেন বানুর কাছে রক্ষিত ছিল বলে দেওয়ান আজরফ জানান।
কয়াফফা সাস্ত্রের জ্ঞান প্রয়োগ করে তিনি বহু বিচার আচার কার্যও সহজে সমাধা করতে পারতেন। এই বিশ্লেষণী ক্ষমতা হাসন রাজার মানব চরিত্র পঠনে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে।
তার এই জ্ঞান দিয়ে তিনি শুধু মানুষকেই বিশ্লেষণ করতে পারতেন না, তিনি দুয়েল, কুড়া, ঘোড়া, হাতি প্রভৃতি পশু পাখিকেও সহজে বিশ্লেষন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতাকে তিনি সৌখিন বাহার পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
হাসন রাজার ভ্রাতুস্পুত্র আজিজুর রাজার কাছ থেকে সংগৃহিত তার পৌত্র দেওয়ান আলমনুর রাজা থেকে একটি ঘটনা শুনা যাক- ‘একবার এক জেলখাটা চোর এসে হাসন রাজার কাছ ভিড়লো। হাসন রাজা তার মুখের দিকে তাকালেন এবং তার চেহারা ছবির একটা নমুনা পেয়ে তিনি তৎক্ষনাৎ তার লোকজনকে ডেকে নিয়ে আদেশ করলেন ‘তাকে দু‘মুঠো খাইয়ে ছয়টি টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও। জানা যায় এতে ঐ চোরের কাছ থেকে আরো বড়রকমের হানিকর চুরির সম্ভাবনা ছিল বলে তাঁর এ রকম সিদ্ধান্ত ছিল।
মানব প্রেমী, হাসন রাজা সমসময় মানুষের মাঝে খুঁজেছেন সৃষ্টির উৎস পরমসত্তা। এই পরমসত্তা সম্পর্কে তিনি স¤পূর্ণ সজাগ ছিলেন বলেই তার মধ্যে কখনও উন্নাসিক মনোভাব আসেনি। হাসন রাজার মানসলোকের পরিচয় পাওয়া যায় তার রচিত গানের ভিতর। তার বাস্তব জীবনের ব্যক্তিগত পরিচয়ও ফুটে উঠে তাঁর সত্যিকারের বাস্তব জীবন বর্ননায়। ‘হাসন রাজার চরিত্রে উদারতা, ক্ষমা, করুনা, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি গুণের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা তাঁর প্রকৃতিও স্বভাবগত, তা না থাকলেই বরং অবাক হওয়ারই কথা ছিল। কারণ অন্তরে অন্তরে যিনি ছিলেন পরমাত্মার স্পর্শ লাভে উন্মুখ, তার জীবনবোধ সংকীর্ণতার গন্ডিতে সংকুচিত থাকতে পারে না, বিশ্বমানবের সঙ্গেই তার আত্মীয়তা।
বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও সুফি সাধনা-চিন্তা-চেতনা সমন্বিত হাসন রাজার চিত্ত তথা পরম প্রজ্ঞা ‘হাসন জান’ তাঁর একান্ত পাশে অবস্থান নিয়েছে। নৃপেন্দ্র লাল দাসের অভিমতে, বাউল, সুফি, বৈষ্ণব আর তান্ত্রিক সমস্ত শিরোপাকে ছিন্ন ভিন্ন করে হাসন রাজাকে একান্তই ‘হাসন রাজা বলে চিহ্নিত করতে হলো।... বাউল ও সুফিমত তার সঙ্গে মিশেছে কবির নিজস্ব চিন্তা আর কবির লোকজ ভাবনা, লগ্ন হয়ে আছে সেই মননে এবং এসবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে যে মত তাকে বলা যেতে পারে হাসন মতবাদ বা হাসনিক মতবাদ।’
তিনি প্রেমাস্পদের সাথে, পরম স্বত্ত্বায় বিলীন হওয়ার সাহসিক ঘোষণা দিয়েছেন। কোন বিশেষ রাজনৈতিক ধর্মীয় মতানুসারী গোষ্ঠী-সচেতন হয়ে অথবা তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে কোন ভাবানুভূতি প্রকাশে হাসন রাজার কোন মাথা ব্যথা ছিলো না। গভীর অনুরাগের সাথে সর্বন্তকরণে ‘নিখিল বিশ্বে’ ও সর্বেশ্বরবাদে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিলো। গভীর ভরসা যেমনি আসমানী শক্তিতে, তেমনি গভীর আস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো মাটিতে, মানুষের পারস্পরিক অন্ত:সংস্পর্শে। উভয় মাটি এবং আসমানী বন্ধনশক্তিতে তার সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিলো। মাটিতে পেয়েছেন তিনি ঐশী শক্তির সন্ধান আর নৈতিক ভিত্তি পেয়েছেন ব্রহ্মান্ডের পরমসত্ত্বায়। ‘হাসন রাজার জীবন দর্শনের বিশেষত্ব এই যে তার জীবনে দেহের ও মনের সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তির মাধ্যমে সর্বেস্বরবাদ প্রতিষ্ঠার করার সাধনায় রত ছিলেন।
হাসন রাজা কষ্মিনকালেও প্রজা অত্যাচার, প্রজা উৎপীড়ন, জুলুমবাজী উশৃংখলতার আশ্রয় নেন নি। কেউ কেউ এ ব্যাপারটিতে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। কোন প্রামাণিক ভিত্তি বা সত্যতা অথবা কোনরকম গবেষনা ছাড়াই হাসন রাজাকে শুধুমাত্র জুলুমবাজী বানাননি, উপরন্তু তারা তার চরিত্রকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার প্রয়াত লোক-সাহিত্য গবেষক প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত ১৯৭৬ সালে তার ‘গানের রাজা হাসন রাজা’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বাংলাদেশের একজন তরুণ নাট্যকার... কল্পনার রঙ ফলিয়ে এক মুখরোচক নাটক সৃষ্টি করেছেন বলে শুনেছি। তিনি লিখেছেন হাসন রাজা নাকি যৌবনে এত উচ্ছৃংখল ছিলেন যে, সুরমা নদীতে নৌকাযোগে কোনো সুন্দরী নারীর যাতায়াত করার জো ছিল না, হাসন রাজা তাকে জোর করে নিজের হেরেমে নিয়ে আসতেন। একবার এক বোরখা পরা নারীকে জোর করে নিয়ে এসে দেখেন যে, তিনি আর কেউই নন, স্বয়ং তার মা। ইত্যকার ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই হাসন রাজার মনে বৈরাগ্য দেখা দেয়। এইসব চমকপ্রদ ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত হয়ত জমজমাট নাটক রচনার পক্ষে সুলভ উপাদান, তবে তার দ্বারা যদি কোন কল্পিত নায়কের চরিত্র সৃষ্টি করতেন, তাতে কারো কিছু বলার থাকতো না। কিন্তু এইসব কল্পিত ঘটনাকে একটি বাস্তব চরিত্রের উপরে আরোপ করা শালীনতা বা ন্যায়নীতির পরিচায়ক নয়।’
সত্তর দশকের এই সস্থা মুখরোচক কল্পিত চরিত্রায়নে হাসন রাজাকে যেভাবে কলুষিত করার অপচেষ্টা চালানো হয় তার জের ধরেই পরবর্তীকালে এর পূনরাবৃর্ত্তি হয় চাষী নজরুল পরিচালিত ‘হাসন রাজা’ চলচ্চিত্রে। যাঁরা হাসন রাজাকে এভাবে অবমূল্যায়ন করেছেন তা জাতির জন্য দৈনতা রেখে যাচ্ছেন। অথচ হাসন রাজা মানুষের রাজা ছিলেন ও পরোপোকারের স্বার্থে মানবপ্রেমী হাসন রাজা একের জন্যে অন্যের প্রীতি প্রেম, ভালোবাসার জরুরৎ অনুভব করে তাকেই সবসময় সন্ধান করেছেন।
৭.
মরমি দর্শনে হাসন রাজার বিচরণ বলতে মূলত তার নৈসর্গিক এক পর্যটকের পরিক্রমণকেই বুঝায়। সে পর্যটনে তার ভিতর-বাহির বিচরণ করে রঙ্গের মানুষকে খোঁজে দেখার যেনো অন্তহীন এক প্রয়াস। প্রিয়ার জন্যে তিনি পাগল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনভর। রাতভর জেগে দেখা পাওয়ার আশায় তিনি প্রার্থনায় রত ছিলেন আর সেক্ষেত্রে তিনি মুসলিম সমাজের সকল প্রচলিত রীতি পরিত্যাগ করে, এ বিশ্ব সংসারকে একটি বিস্তৃত মহাসাগর রূপে নিজের চোখে অঙ্কিত করেছেন। হাসন রাজা নিজেকে এ সংসারে একজন পর্যটক হিসেবে ধারণা করেছেন। এ পর্যটক আবার নানা অভিজ্ঞতা লাভে ব্যস্ত। তিনি স্বদেশে ফিরে যেতে চান। তবে তার সম্মুখে রয়েছে এক বিরাট নদী। এ নদী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম একখানা নৌকা এবং তার মাঝি ‘গফুর'-অর-রহিম। খেয়ানীর সহানুভূতিপূর্ণ বদনমন্ডল আর তার কোমল হৃদয়ের আভাস পেয়ে তিনি উল্লসিত হয়ে বলেন ‘খেওয়ানীর মুখ দেখিয়া মনে হইছে আশা।’ তবে তিনি অপ্রকৃতিস্থ। একটি ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এত পরিক্রমণের পর যখন দেখা গেলো হাসন রাজা যেনো এক সর্বেশ্বরবাদের দ্বারে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং দেখলেন এই সর্বেশ্বরবাদিতায় কোনো কপটতা ও ভন্ডামীর উপস্থিতি একবোরেই অসহণীয়। তিনি স্থীর হলেন। গভীর দর্শন প্রজ্ঞার চোখ উন্মিলিত করেন।
প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন- ‘যে সমাজে যে পরিবেশে ও যে নৈসর্গিক ভূখন্ডের বৈচিত্র্যলীলার রাজ্যে তিনি জন্মেছিলেন, তাদের প্রতি তার নাড়ির টান ছিল। সিলেটের নদী-নালায়, খাল-বিলে, হাওরে, পাহাড়ে, গ্রামাঞ্চলে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়ে মন-প্রাণকে যেন সজীব সতেজ করে আনার জন্য তিনি নিয়মিত পর্যটনে বেরুতেন’। সুরমা নদী ছিল তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। এই সুরমার বুকে হাসন রাজা কত যে জল-সিক্ত হয়েছেন, আর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের কলোধ্বনিতে কত যে তার ভাবে কৃষ্ণ-রাধার লীলাখেলা চলেছে সেকি আন্দাজ করার মত? সুরমা নদী দিয়ে তিনি চলেছেন তার রংয়ের পানসী ভাসিয়ে গান হচ্ছে। এবং ?
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: