পুস্তক: হাসনরাজা ও তাঁর সাধনা
সুনামগঞ্জ ও হাসন রাজা
প্রকাশিত:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:১৯
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪১

সুনামগঞ্জ হাসন রাজার জন্মস্থান।
৬৪১ সালে পরিব্রাজক হিউয়েন সাং জলপথে এবং ১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা বিরাট সাগর পার হয়ে এসেছিলেন সিলেটে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে হাসন রাজার পূর্ববংশপুরুষ রাজা বিজয় সিংহদেব বিশাল জলভূমি পার হয়ে এবং আরো পরে তদানিন্তন রেসিডেন্ট কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে এই বিরাটকায় জলরাশি অতিক্রম করেন ১৭৭৮ সালে সিলেটে এসে পৌছান। লিন্ডসে সাহেব সেই আগমনের মনোজ্ঞ বিবরণে এই এলাকার প্রাকৃতিক যে অবস্থার কথা বর্ণনা দিয়েছিলেন তাতে সুনামগঞ্জের নাম উল্লেখ না করলেও এলাকার চিত্রটি নিপুনভাবে ভেসে উঠে।
কোম্পানি আমলের পর শুরু হয় ব্রিটিশরাজের সময়কাল ১৮৫৮-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। উল্লেখ্য এই মেয়াদ কালটির শুরুর ঠিক চার বছর পূর্বে হাসন রাজার জন্ম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটে। সুতরাং দেখা যায় ব্রিটিশকালেই ছিল হাসন রাজার জীবনকাল।
২.
ব্রিটিশরাজের রাজত্বকালে ১৮৭৭ সালের আগ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ নামে কোনো অঞ্চলের অস্থিত্ব ছিল না। তবে ‘লক্ষণরাম দাস নামক জনৈক ব্যক্তির নামানুসারে লক্ষণশ্রী নামে একটি পরগনার অস্থিত্ব বিদ্যমান ছিল। খুব সম্ভবতঃ সুলতানী যুগের শেষের দিকে অথবা মোগল যুগের প্রথম দিকে এই লক্ষণরামের জীবনকালটি ছিল এবং তার মৃত্যুর কয়েক বছর পরই এই পরগনার নামকরণ হয় ‘লক্ষণশ্রী’।
তবে লক্ষণশ্রীর লক্ষনরামের কিংবা আর কোন স্থানীয় দেওয়ান বংশের সাথে দেওয়ান হাসন রাজা বংশের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এ ব্যাপারে অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি মহাশয় কল্পনার আশ্রয় নিয়ে খুজার চেষ্টা করেছিলেন এবং কোন ভিত্তি ছাড়া সে সম্পর্কটি প্রতিষ্টিত করতে চেয়েছিলেন । হাসন রাজার পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার দেয়া তথ্যাদি অনুসরন করলে দেখা যায় এ ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। সুনামগঞ্জে “খাসিয়া দমানার্থে প্রেরীত অয়েজদি কোরেশীর এক পূর্ব-পুরুষ মুর্শিদাবাদের নবাবদের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়ে এ দেশে প্রেরিত হয়েছিলেন। সেই যুগ ছিল মোগল আমল। তাঁর পরলোকান্তে ঐ অয়েজদি কোরেশী পদাভিসিক্ত হন। এরা কোনসময়ই দেওয়ান নামে পরিচিত ছিলেন না। এখনও তাঁদের বাড়ীর চারপাশে দেওয়ালের চিহ্ন বর্তমান আছে। তাঁর এই জীবনকালটি ছিল ১৭১২ সন থেকে ১৭৮৯ সন পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে এই অয়েজদি কোরেশীর বোনের সাথে হাসন রাজার প্রপিতামহ রাজা বিরেন্দ্ররাম সিংহদেব ওরফে বাবু রাজা ওরফে বাবর রাজার বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। সুনামগঞ্জে একটি জায়গায় অয়েজদি কোরেশী খনন কার্য করিয়ে সেই খালের পারে এক গ্রাম বসান। হাসন রাজার পুত্রদের সময়েও সেই গ্রাম ‘অয়েজদি-খালি’ নামে পরিচিত ছিল। অয়েজদি চৌধুরীর নামেই ইংরেজরা জায়গাটি ‘অজখালি’ নাম ধরে দশশনা বন্দোবস্তের সময় লক্ষনশ্রী পরগনার ‘১ নং তালুক’ তাঁর নিজ পুত্রের নামে ‘গোলাম আলী তালুক’ বলে বন্দোবস্ত দিয়েছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সিলেট থেকে আসার পথে এই শহরতলির অংশটুকু অজখালি নামে পরিচিত আছে। হাসন রাজার পিতা আলী রাজা ও ঐ আলী রাজার আপন খালাত্ব ভাই লক্ষণশ্রীর জমিদার আমির বক্স চৌধুরী। তাঁদের আপন মামা গোলাম আলী ইংরেজ আমলে বিশেষ সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে গনিউর রাজা উল্লেখ করেন। তাঁর কোন পুত্রকন্যা সন্তানাদি না থাকায় পরবর্তীকালে তাঁর দুই বোনের দুই ভাগ্নে আমীর বক্স চৌধুরী এবং দেওয়ান আলী রাজাকে সেই সম্পত্তির বেশীর ভাগ অংশের ভোগদখলকার মালিক করিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে হাসন রাজা এই দুজনের উত্তরাধিকারী-সুত্রে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেন।
লাউর রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল বর্তমান পুরো সুনামগঞ্জসহ হবিগঞ্জের কিয়দংশ এবং ময়মনসিংহ পর্যন্ত। মোগল আমলের রেকর্ড পত্রাদিতে লাউর পরগনার উল্লেখ পাওয়া যায়। পরগনার নাম বলতে গিয়ে ইতিহাস লেখক সাজ্জাদ হোসাইন উল্লেখ করেছিলেন, ‘আতুয়াজান, জাতুয়া, পাগলা, লক্ষণশ্রী, শিকসুনাইত্যা, দোহালিয়া, হাউলি সোনাইত্যা, নইগাং, সুখাইর, পাইলগাঁও, সিংচাপইড় দোওজ, বেহেলী, গ্যেরারং, নাওড়াবেতাল, খালিসা বেতাল, মহারাম ও সেলবরষ পরগনা’।
তখনও সুনামগঞ্জের নামের অনুপস্থিতির কারনে এর নামকরন বিষয়ে কয়েকটি মতামত খুজে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের ধারনা অনুযায়ী অতীতে সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও ঐশ্বর্য্য ছিল বলে এই সুনামটি ধরে রাখার উদ্দেশ্যেই এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষেরা একে নাম দিয়েছিল ‘সুনামগঞ্জ’। ‘সুনাম’ অর্থ ‘খ্যাতি’ এবং ‘গঞ্জ’ অর্থ এলাকা বা বাজার।
আমার সহকর্মী এলেন হিউজ (Allen Hughes)-র মতে, ১৭৭২ সালের দিকে সিলেটে আগত প্রথম রেসিডেন্ট কালেকটার (প্রশাসক) মেইকপিস থেকারের উল্লিখিত Chunam (চুনাম) শব্দ থেকে সুনামগঞ্জ নামের উদ্ভব হতে পারে বলে ধারনা নেয়া যায়। ইংরেজী ‘চুনাম’ শব্দের অর্থ হলো ভারতে একধরনের চুন পাউডার ও বালু জাতীয় বড় বড় পাথরের টুকরা যাকে প্লাস্টারের জন্যে ব্যবহৃত হয়। কেননা থেকারের মতে এই এলাকায় প্রচুর চুনামের (চুন) অস্থিত্ত্ব রয়েছে। এলেনের মতে খুব সম্ভবত: পরবর্তীকালে এই ‘চুনাম’ শব্দটি ‘সুনাম’ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে এবং এর থেকেই এই এলাকার নামকরন হয়েছে ‘ছুনামগঞ্জ’ অর্থাৎ ‘ছুনের বাজার’। তবে এলেন হিউজের এটি একটি ধারনামাত্র।
১৭৭৮ সালের সিলেটের বিখ্যাত রেসিডেন্ট কালেক্টর লিন্ডসে সাহেবের আত্মজীবনীতে উল্লিখিত আছে- কোম্পানি আমলে সমগ্র সিলেটে মোগল-যুগের প্রশাসনকে বহাল রেখেই আঞ্চলিক প্রশাসনিক কার্য্যাদি চালিয়ে যাবার রীতি ও নীতিতে পরবর্তীকালের সীমান্ত অঞ্চলের সেনাপতি কিংবা সিলেটের ফৌজদারগনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এই মতানুসারে দেখা যায় ‘লক্ষণশ্রীর চৌধুরীগনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এর পান্ডুলীপিতে গনিউর রাজা তুলে ধরেছেন যে ঐ অয়েজদি কোরেশী বা মুরাদ বেগ ছিলেন তখনকার সুনামগঞ্জ এলাকার আঞ্চলিক সিমান্ত সেনাপতি। মোগলযুগের শেষ দিকে মুর্শিদাবাদ থেকে আগত সীমান্ত সেনাপতি অয়েজদি কোরেশী খাসিয়া দমনে বিশেষতঃ লাউর ও খাসিয়া রাজ্যের সীমান্ত বরাবর বনগাও [গনিউর রাজার তথ্যকথায় বনগাওকে একটি থানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে] থানাধীন অঞ্চলগুলা তত্বাবধান ও পর্যবেক্ষনের দায়িত্বে তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন মির্জা মুরাদ বেগ। ফলে মোগলযুগের শেষ-প্রান্ত গড়িয়ে এবং কোম্পানীযুগে এসে সেনাপতি মির্জা মুরাদ-বেগ ‘সুনামদি’র নাম ধরেই ১৭৯৩ সালে লক্ষণশ্রীর ১২ নং তালুকটির যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু করান, তা-ই এই এলাকার নামের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পটভূমিকা তৈরী করেছে।
তথ্যদাতা হাসন রাজার পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজা ছিলেন একজন অবৈতনিক মেজিষ্ট্রেট। তার সময়কার সরকারী এবং বেসরকারী তথ্যের উপর নির্ভর করে আমাদেরকে তিনি জানিয়েছেন যে, তাঁর জন্মের ৮১ বছর পূর্বে ১৭৯৩ সালে যে বন্দোবস্থ হয়, তাতে লক্ষনশ্রী পরগনার তালুকগুলার মধ্যে ১২নং তালুকের এলাকার ধরন এমন ছিল যে ‘অত্যন্ত জঙ্গলময় ও বেতগড়া, গর্ত-খন্দক থাকাতে তা লক্ষনছিরির কোন মিরাসদার অযোগ্য ও অকর্মন্য বিবেচনায় বন্দোবস্থ নেন নি। গবর্নমেন্ট প্রেরীত খাসিয়া দমনকারী সেনাপতি মির্জা মুরাদবেগ তাঁরই জনৈক সুনামদি নামক ভৃত্য দ্বারা এই তালুকটিকে বন্দোবস্থ নিয়েছিলেন এবং কয়েক বছর পর নদীর ধারে কয়েক স্থান জঙ্গল আবাদ হলে ঐ স্থানেই সুনামাদি নামক বাজার বসিয়েছিলেন। বর্তমানে উক্ত বাজার জলশুকার মিরাসদারগনের হাতে গিয়েছে। সেনাপতি মির্জা মুরাদ বেগ কর্তৃক তাঁর দেহরক্ষী ভৃত্যের আনুগত্যের স্বীকৃতিস্বরুপ ‘সুনামদি’ নামে এই ১২নং তালুকটি যে সুনামগঞ্জের নাম সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে তা আজকের দিনে অবিশ্বাস্যরকম। গনিউর রাজার এই তথ্যকে সমর্থন যোগান ‘সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’এর লেখক আবু আলী সাজ্জাদ হোসেন। তার গ্রন্থে বলেছেন- ‘সুনামদি নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। মুরাদ বেগ যখন তাঁর চাকুরী জীবনের অবসানে মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তাঁর পরিচালনাধীন লক্ষণশ্রীর সুনামদি নামক তালুকটি অয়েজদি কোরেশীর পুত্র গোলামআলীর কাছে সমজিয়ে দিন। সুনামদি ও তাঁর পরম্পরা বংশধরগনকে সকলরকম উপকার সুবিধা ভোগের প্রতিশ্রুতিতে এই তালুকটির দায়িত্ব নিয়োজিত থাকে তাঁর হাতে। অয়েজদি কোরেশী ও তাঁর একমাত্র পুত্র গোলাম আলী ইহলোক পরিত্যাগ করলে পর অয়েজদি কোরেশীর কন্যাসন্তান সবরজাহানের পুত্র আমীরবক্স এই উপরোক্ত তালুকটির ভার গ্রহন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হাসন রাজার মাতা হুরমত জাহান বিবির কাছে এই তালুকটি হস্তগত হলে আলী রাজা এই তালুকটির প্রায় সম্পূর্ণ ভুমিটিই সুনামদির বংশধরগনের কাছ থেকে কিনে নেন। হাসন রাজা তার বিশ একুশ বয়সকালের এক কঠিন সময়ে হবিগঞ্জের জালসুকার হিন্দু সাও জমিদারদের কাছ শোধে কাটানো বেশ কিছু ক্যাশ টাকা বা অর্থ কর্জ করেন। শোধে-আসলে কয়েকহাজার টাকা হওয়ায় হাসন রাজা তখন তাঁদের কাছে কিছু সময় চাইলেও জালশোকার জমিদার সুনামদি বাজার সমেত ১২ নম্বর তালুকটি দাবী করেন। পাশাপাশি হাসন রাজার উপর এক অনাদায়ের মামলাও টুকে দেয়। মাতা হুরমত জাহান বিবি অল্পবয়স্ক পুত্রের এই বেগতিক অবস্থা দেখে এই ১২ নম্বর তালুকটি জলশোকার জমিদারের কাছে ছেড়ে দিতে বলেন। আর এইভাবেই বাজারটি চিরকালের জন্যে হাসন রাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। গনিউর রাজার উক্তি থেকে জানা যায় যে পরবর্তীকালে এই ১২ নং তালুকটি জলশোকার জমিদারদের হাতে যাওয়ায় কারনে বাজারটির নাম পরিবর্তিত হয়ে দাড়ায় ‘সুনামগঞ্জ বাজার’। জলশোকার জমিদাররা হবিগঞ্জ থেকে অনেক ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করে এই বাজার এলাকায় এনে বসান। আগত এই নুতন সম্প্রদায়ের ব্যবসা কলেবরে সুনামগঞ্জের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় হাসন রাজা তাদের প্রশংসা করতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। আজও এদের বংশধরগণ এই বাজারে প্রধান ব্যবসায়ী হিসেবেই আছেন।
রাধারমন মিত্রের ‘কলিকাতা দর্পন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়- উনিশ শতকের প্রথম ভাগের দিকেও ‘কলকাতা’ নামের অস্থিত্ব ছিল না বা তার কোনো প্রমাণাদিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিক দিয়ে বুঝা যায় যে, ‘সুনামগঞ্জ’ এর আনুষ্ঠানিক নামটি অন্তত: পক্ষে ১৮৭৭ সালের আগে কোথাও উচ্চারিত হয়নি। ঐ বছরেই ইংরেজ শাসক গুষ্টি অনুধাবন করলেন যে লাউর রাজ্যের পাশাপাশি এক বিস্তৃত সমতল ভূমিকে তাঁদের করতলে রাখার সুবিধার্থে সুরমা নদী তীরবর্তী এই সুনামদি বাজার তথা সুনামগঞ্জ বাজার সমেত জায়গাটুকুকে প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা জরুর হয়ে দাড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে ব্রিটিশরাজ ঘোষনা দিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্টার। আর এভাবেই সুনামগঞ্জ নামটির উদ্ভব। এভাবেই ভাবনার উদ্রেক করে আমাদের তরুন কবি হাসন রাজার চোখের সামনে দিয়ে সুনামগঞ্জের উৎপত্তি।
৩.
সুরমা নদীর তীরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে হাসন রাজা বেড়ে উঠেন। জন্মের পর থেকেই একমাত্র শিশুপুত্রকে মা হুরমতজান বিবি যক্ষের ধনের মত আগলিয়ে রাখতেন। চারপাশে লোকে লোকারন্য ভরা হাসন রাজার বাল্যকালটি ছিল ছবির মত রঙিন। বাড়িভরা পরিচারক পরিচারিকার মধ্যে শিশুকালটি ছিল উৎসবমোখর। একদিন হুরমতজাহান বিবি ঘরে বসে কাজের মহিলা সোনার মা-কে ডাকলেন। আদেশ হলো ‘আমার হাসনকে সুরমাপারে খোলা বাতাস খাইয়ে আন্।’ তিনি ভাবলেন এই বদ্ধ পরিবেশে হাসন বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছে। চার বছরের শিশু হাসন রাজার খোলা হাওয়ার স্পর্শে প্রাণটা জুড়ালো। পরবর্তীকালে হাসন রাজা তার নিত্য সহচর ‘উদাই’ জমাদারের কাছে স্মৃতিচারণ করেছেন এই বলে যেদিন তিনি প্রথম সুরমার পারে দাঁড়িয়েছিলেন, তার কাছে সেদিনের আবছা জগতটা ছিল যেন এক বিশালকায় দুনিয়া। প্রকৃতির সাথে হাসন রাজার এই প্রথম পরিচয়। দিগন্ত-বিস্তৃত এক অপূর্ব আলোর ছোয়াছ যেনো তার চোখেমুখে এসে ঠেকে। সুরমা জলরাশি ছুয়ে যেন উত্তর-পশ্চিম দিগন্ত বরাবর হেলান দেয়া খাসিয়া পাহাড় অবাক করলো বালক হাসন রাজাকে। চেয়ে রইলেন সেই দূরের প্রান্ত ছুঁয়া নীল পাহাড়ের দিকে। শিশুকালেই সুনামগঞ্জের মাটি, মানুষ আর প্রকৃতি এই তিন মিলে শিশু হাসন রাজার চিন্তা চেতনা, ভাবনা, ভাষা আর আঞ্চলিক শব্দচয়নের একটি মানসপট তৈরি করে। এর পরপরই কৈশোরকালে তার মধ্যে একটি কাব্য সম্মিলন ঘটে। ‘সৌখিন বাহার’ কাব্যের গাথুনি শুরু হয়। মাত্র ছয় কি সাত বয়সে বোন সহিফা বানুর নৈকট্য লাভ করেন হাসন রাজা। সিলেটে সাঈদিয়া মাদ্রাসায় বছর তিনেক পড়ালেখার পর সুনামগঞ্জে আবার ফিরে আসেন। প্রায় সমবয়সী সহোদর মুজাফ্ফার রাজা ও বোন সহিফা বানু হয়ে থাকেন ছেলেবেলার সঙ্গী।
হাসন রাজার বয়স তখন আট কি নয়। বাবা আলী রাজা রামপাশার জমিদারী সহায়-সম্পত্তি তদারকি করার লক্ষে বছরের মাস আটেক পর্যন্ত রামপাশায় অবস্থান করতে শুরু করলেন। শৈশবে বাবার উপস্থিতির অভাব সত্ত্বেও অন্দরমহলের চারপাশ আলোকিত করেছিলেন তার মা। ঘরের বাইরে প্রকৃতিপ্রেমী বালক হাসন চষে বেড়াতে থাকেন বন বাদার, হাওর জঙ্গল, নদী নালা আর খাল বিল। সুনামগঞ্জের অনাবিল প্রকৃতি, আর কুড়া, দোয়েল, ময়না, সারস, মুনিয়া, টিয়া তাঁর চতুষ্পার্শে। দশটি গ্রাম্য খেলার সাথীদের সঙ্গে সহজিয়া জীবনের সুত্রপাত এসময়ই। দলবেধে খোলা আকাশের নীচে দৌড়ঝাপ, দিঘীর পানিতে সাঁতার কাটা, ভেলায় চড়ে নদীতে ভেসে বেড়ানো, ঘুড়ি উড়ান, লুকোচুরি ইত্যাতিতে তাঁর আনন্দের সীমা নেই।
বাবার সঙ্গে রামপাশায় গেলে পর বড় ভাইয়ের কাঁধে চড়ে গ্রাম ঘুরে বেড়ানো, কখনো বা কাপনা নদীর পাড়ে। রঙিন গানে-আনন্দে, কোলাহলে মুখরিত রামপাশা । সংগীতের সাথে এই প্রথম তাঁর পরিচয়।
হাসন রাজার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে। গ্রামবাসীর সুখ দুঃখ হাসি কান্নার সাথে সবসময়ই তিনি জড়িয়েছিলেন। আর সেজন্যেই গ্রামের প্রতি তার বিশেষ মায়া। সচরাচর আর দশজন জমিদারের ন্যায় অনায়াশে নিজের জন্যে লখনউ, কলকাতা, ঢাকা কিংবা সিলেট শহরে তার ঘরবাড়ি থাকতে পারত। কিন্তু শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে আরাম আয়াশ তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সাদামাটা লক্ষণশ্রী গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে হলো না তাঁর কোনদিনই।
ছেলেবেলায় একবার তাঁর কুস্তিখেলা দেখার সুযোগ হয়, আর আরেকবার শুনেন ঘাটুগান। এই দুটো জিনিসই হাসন রাজার বড় অপছন্দের। এগুলো দেখলেই তার মেজাজ মর্জি খারাপ উঠতো। এতে কেমন যেনো একটি কৃত্রিমতা আর পশুত্বভার লুকিয়ে রয়েছে। এই সময় একদিন হাসন রাজা তাঁর মায়ের এক কষ্টের কথা জানলেন। বিষয়টি সরাসরি মায়ের মুখ থেকেই জেনেছেন। তাঁর বাবার সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেই মা ছিলেন লক্ষণশ্রী পরগনার জমিদার আমির বকস চৌধুরীর স্ত্রী। সুদুর নেত্রকোনার কালিয়াজুড়ি থেকে বিয়ে হয়ে এসে হুরমত জাহান বানু সুখে শান্তিতে তাঁর স্বামীর ঘরসংসার করে যাচ্ছিলেন। সুখের নৌকোয় জন্ম নেয়া একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর ঘর ছিলো আলোকিত। সেই সুখের সংসারে একদিন আসলো একটি বড় ঝড়। তছনছ করে নিয়ে গেল তাঁদের সমস্ত সুখ শান্তি।
শুনেন সে কাহিনী। আমির বক্স ছিলেন একজন ধর্মপ্রান ব্যক্তি। পির ফকির আওলিয়া বুজুর্গে ছিলো তার অগাধ আস্থা। তাই যখনই কোন পির ফকিরের নাগাল পেতেন, তখনই তাকে আকড়িয়ে ধরতেন। ছাড়তে চাইতেন না। তার বাড়িটি ছিল অথিতিশালার মত। অতিশয় অতিথিপরায়ন আমির বক্স চৌধুরী তার জ্যৈষ্ঠ পুত্রের মাথার উপর খাসার খাঞ্চা তুলে নিজের হাতে চামচ নিয়ে অতিথি মুসাফেরগণকে খাবার বেটে দিতেন। সেখানে হিন্দুস্থানী ফকিরগণসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে পির ফকির আথিত্যগ্রহণ করতেন। তারা বিদায়ের সময় কত যে অথিতি-উপঢৌকনও নিয়ে যেতেন তার কোনো শেষ ছিল না। এই ধারায় কোন কোন পির ফকির সুনামগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস করার নজীর পাওয়া যেতো। এই ধারায় প্রায় দুই শত বছরের কালের আবর্তনের পরও আজো সুনামগঞ্জ শহরে পির ফকিরের যথেষ্ট বংশধরের অস্থিত্ব খুজে পাওয়া যায়।
যাই হোক একদিন এক হিন্দুস্থানী ফকির উপডৌকন না নিয়ে জিদ ধরে বসে যে, আমির বক্সে চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্রের চুয়াড়ি তাজি ঘোড়াটি সে নিয়ে যাবে। তিনি ফকিরকে জানালেন তাঁর বড় ছেলে সখ করে এই ঘোড়াটি কিনেছে, সাদা রঙের এই তাজি ঘোড়াটি ছেলের অত্যন্ত সখের, তাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। ফকির জানাল, এই ঘোড়া না দিলে হবে না, সে অন্য কিছুই চায়না। এমনি অবস্থায় বাড়ীর ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করায় হুরমতজাহান বিবি ছেলের এত সখের ঘোড়াটি না দিয়ে ঘোড়ার সমান মূল্য টাকা দিয়ে ফকিরকে সন্তুষ্ট করে দিবার পরামর্শ দেন। কিন্তু ফকির জানালো, সে ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই নেবে না। আমির বক্স তাঁর পায়ে ধরে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করার পরও ফকির কিছুই না শুনে চলে গেল।
এই হিন্দুস্থানী ফকিরের প্রস্থানের কিছুদিন পরই আমির বক্স চৌধুরীর তিন ছেলে, যথাক্রমে সিকান্দর বক্ত, রেজওয়ান বক্ত, সৈইদ বক্ত এবং এক কন্যা সওয়ারী বানু বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথে যাত্রা করে। আমীর বক্স চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এর কিছুদিন পর তাদের ঘরানা পির হারুলিয়ার পিরসাব মওলানা সৈয়দ আরজদ আলী সাহেব তেঘরিয়ার সাহেববাড়ীর ঘাটে নৌকা লাগালেন। ঘাটে নৌকা ভিড়ানোর পরপর আরজদ আলী পিরসাব এক শুনা কথায় কান দিলেন। জানলেন, আমির বক্স চৌধুরী এক হিন্দুস্থানী ফকিরের মুরিদ হয়েছেন, তখনই তিনি রাগান্বিত হয়ে নৌকার মাঝিকে আদেশ করলেন এই বলে যে, এক্ষুনি আটকুঁড়ের (নির্বংশ) বাড়ীর ঘাট হতে নৌকা ছাড়ার জন্যে। এই কথা চৌধুরী সাহেব যখন অন্য লোক মারফৎ শুনলেন তখন তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন, আমার ঘরের পিরসাব যদি এই কথা বলেন, তাহলে আল্লাহ যেনো তাঁকেও নির্বংশ করেন। এরপর আমির বক্স আর বেশী দিন বাঁচেননি, তাঁর চার সন্তানকে অনুসরন করে তিনি নিজেও পরলোকে পাড়ি জমান। আর অন্যদিকে, হারুলিয়া পিরেরও একমাত্র পুত্র কোনো এক রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নিজের কোন বংশ না থাকায় সৈয়দ মুহম্মদ আরজদ আলী পিরসাব তাঁর ভাগ্নে সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া ওরফে কনু মিয়াকে পালক-পুত্র করে রাখেন। বর্তমান হারুলিয়ার সৈয়দ বংশধরগন ঐ ভাগ্নের বংশধর। হাসন রাজার জেষ্ট্য পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার বিবৃত উপরের দুটি ঘটনা থেকে অনেকটা আঁচ করা যায় যে তিনি তাঁর পিতামহি হুরমতজাহান বিবির স্বামীহারা, পরবর্তীকালে তাঁর স্বামীর খালাত ভাই আলী রাজার সাথে বিবাহবন্ধন এবং পিতা হাসন রাজার জন্মের সাথে যেনো এর একটি অ’লক্ষনীয় অমোঘ সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হাসন রাজা যখন তার বছর বয়সে সে কথা জানলেন, মায়ের কষ্টটি তার বুকের মাঝে গিয়ে এক বাসা বাধলো। ধারন করলেন সেই ব্যাথাটি তার গভীর মনে।
এরমধ্যে সুনামগঞ্জের অনাবিল প্রকৃতি আর মানুষের সাথে মিলেমিশে গিয়েছিলেন হাসন রাজা। এসময় কুড়া পাখির সাথে হাসন রাজার মনটা ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। গনিউর রাজা বর্ণীত হাসন রাজার কুড়া শিকাড়ের অসংখ্য জায়গার নাম জানা যায়। শুধুমাত্র লাউড় অঞ্চলে ৩৪টি স্থানের নাম এবং সিলেটে ১৬টি স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। ঠিক তেমনি সিলেটের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলে অর্থাৎ এখনকার বিশ্বনাথ এলাকায় অসংখ্য স্থানে তাঁর বিচরন ঘটেছে।
বছরের দুই ঈদ ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহার দিনে বালক ও যুবক হাসন রাজা কেবল নিজের রঙিন জামা পরিধান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না, পাড়া প্রতিবেশী ও গরীব লোকের মাঝে রঙিন কাপড় বিতরণে, পিঠা সন্দেশ উপভোগে এবং মানুষের কুশল জানতে তাঁর ছিল অফুরন্ত আনন্দ ও তৃপ্তি। ঈদে মিলাদুন্নবীতে ঘরে ঘরে মিলাদ ও নাথ গানের আসরে সুফি সুরভান্ডারের স্বাধ নিতেন তিনি। ঠিক বিপরীতে বিষাদময় মোর্হারম উদযাপন তরুণ ভাবুক হাসন রাজাকে উদাসীন করে রাখতো।
শিয়া মতালম্বী সীমান্ত রক্ষক সেনাপতি অয়েজদি কোরেশী [আলী রাজার মাতামহ] ও তার উত্তর পুরুষগণ এবং স্থলাভিসিক্ত সেনাপতি মির্জা মুরাদ বেগের সময়েও বাড়িতে বাড়িতে মহা ধুমধামের সাথে মুহররম পালিত হত। মুহররম উপলক্ষে তাজিয়া বের করা হত। পরবর্তীতে বহু বছর যাবত এই রেওয়াজ এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। তাজিয়া পর্ব বন্ধ হবার পরও অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো তরুণ হাসন রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
সেকালে সুনামগঞ্জ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। শহরজুড়ে প্রতি বছর পূর্ণোদ্যমে পুজাপার্বণের মাঝে লক্ষ্মীপুজা, স্বরস্বতীপুজা, কালীপুজা ও দূর্গাপুজায় হাসন রাজার জন্যে আমন্ত্রণের অভাব ছিল না। পুজার মাঙ্গলীক দিকগুলা তার কাছে উন্মোচিত হল।
রথযাত্রা বহর ছিল হাসন রাজার কাছে চোখ-ধাধানোর মতো। শহর এলাকা ঘুরে রথযাত্রা পশ্চিম বাজার এসে উপস্থিত হলে লোকবাদ্যযন্ত্রের মহড়া বসত। সেখানে তিনি এক আনন্দঘন পরিবেশে অসংখ্য লোকজনসহ উপস্থিত হতেন। জগন্নাথ পার্বণে ধুমধামের রথযাত্রা এক রঙিন লোকারণ্যে, মানুষের সুর কলধ¦নিতে হাসন রাজার মন মেতে উঠত। বসন্তের ফাগুনে রঙের মাখামাখিতে আনন্দে নাচে, এক পরিশীলিত পরিবেশে কৃষ্ণলীলার হুলিখেলা তার মনকে কেড়ে নিত। প্রাণজুড়ানো গানের ডালি নিয়ে আসতো একদল গায়ক গায়িকা। বসন্তের আগমনে বাজারের ব্যবসায়ী ধনী মহাজন হাসন রাজার পা থেকে কোমর পর্যন্ত আবীর ছড়িয়ে দিত। এরপর পর¯পরের প্রতি ছুড়াছুড়ি করত আবীরের পিচকারী এবং সঙ্গে সঙ্গে সুর মিলিয়ে হলি গানে এলাকা মুখরিত হয়ে উঠত-
আজি ফাগুন ওরে
এই মধুর লগন
মন ময়ুরী নাচে
জাগে ত্রিভূবন
খেলে হুলি কোমল-লোচন।
অথবা-
লাল সরোবর লাল
হইয়াছে আবিরে,
ছি ছি লাজে মরিরে।
হাসন রাজার ফুফুর বাড়ি পিরের গাঁ, জগন্নাথপুর। মনের টানে ছুটে যেতেন সেখানে। গনিউর রাজার দলিলে জানা যায় বেদস্বার লেখক সুফি অলি মরমী কবি শাহ সৈয়দ হোসেন আলমের বংশধর উল্লেখিত নুর আলমের থেকে শুরু করে পিরের গাঁ সৈয়দ বংশের সাথে হাসন রাজার পরিবারের কয়েকবারই স¤পর্ক হয়েছিল।
হাসন রাজা তখন মাত্র পনের কি ষোল বছরে পা দিয়েছেন। বাবা আলী রাজা তখন রামপাশায়। এ সময় একবার বর্ষাকালে সুরমা নদী ফুলে ফেপে উঠেছে। নদীর শ্রোতধারা ধরে লক্ষণশ্রী থেকে অচিনপুর হয়ে যখন নৌকোটি খরচার হাওরমুখী হয়, পড়ন্ত বিকেলের সূর্য তখনো দিগন্ত স্পর্শ করেনি। এমন সময় হাসন রাজার চোখে ধরা দেয় জলরাশির পশ্চিম প্রান্তে এক সুন্দরী গোসল সেরে ছোট্ট গাঙের জল থেকে ডাঙায় উঠছেন। হাসন রাজা কেমন জানি চমকিত পুলকিত হয়ে উঠেন। কেমন যেন এক ভাবাবেগ কাটিয়ে পরক্ষণে তার সঙ্গীদের আদেশ করলেন- বাাড়ির দিকে নাও ফিরাও। খবর পাওয়া গেল ওই কুমারী পাশ্ববর্তী গওরারঙ্গের হিন্দু জমিদার কন্যা। হাসন রাজা ঘরে ফিরে মায়ের কাছে আবদার করলেন- ‘মা, আমি ওই জমিদার কন্যাকে বিয়ে করব’। হিন্দু মসলিম সম্প্রদায় তিনি কিছুই তোয়াক্কা করতে চান না। তিনি ছাড়বার পাত্র নন। মা হুরমুতজান বিবি পড়লেন ভীষণ বিপাকে। এমন অবস্থায় হাসন রাজার একমাত্র মামা এমদাদ আজিজ চৌধুরী ওরফে তুরন মিয়াকে বল্লী থেকে আনতে গয়না নৌকা পাঠান হলো। পরের দিন মামা এলেন। ঐ তরুণীকে তাঁর জীবন-সঙ্গিনী করা চাই। পরবর্তীতে হাসন রাজার একটি গানে উঠে এসেছে এ বিষয়টি-
ঝলমল ঝলমল করেরে তারা
ঝলমল ঝলমল করে
নূরের বদন সই প্রেয়সী
নূরের বদন সই
তারে ছাড়া, বাড়িত আমি
কেমনে করি রই।
ওরে আমার আরিপরি ভাই
তারে আমার বিয়ে করা চাই
হিন্দু আর মুসলমান আমি,
কিছুই বুঝি নাই ॥
অবশেষে মা ও মামার হস্তক্ষেপে হাসন রাজাকে নিবৃত্ত হতে হলো। প্রথম জীবনে সেই প্রবল মনোবাঞ্জা চিরদিনের জন্যে অপূর্ণই থেকে গেলো। সুকুমার সেই প্রেমানুভূতির উন্মেষকালে হাসন রাজার না পাওয়ার বেদনায় বিদুর হয়ে সারাজীবনই সম্ভবত: একটি পরোক্ষ স্বর্গীয় প্রেমভাবে তিনি সিদ্ধ সাধনার দিকে পথ বাড়ালেন। এসময়ই সেই অপূর্ব জনপ্রিয় গানটি কাব্যের রূপ ধারন করলো-
দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল
আরে না জানি কি মন্ত্র পড়িয়ে যাদু করিল ॥
কিবা ক্ষণে হইল আমার, তার সঙ্গে দেখা
অংশীদার নাইরে তার সে তো হয় একা ॥
রূপের ঝলক দেখিয়ে তার, আমি হইলাম ফানা
সে অবধি লাগল আমার, শ্যাম পিরীতের টানা ॥
সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল
সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল ॥
ওদিকে বড় ভাই উবায়দুর রাজার জৌলুসপূর্ণ জীবনে অর্থ ব্যয়ের কোনো বাধ ছিল না। পাওয়ার আকাঙ্কাও তার জীবনে কম ছিল না। উবায়দুর রাজার অমিতব্যায়িতার জন্যে সমস্ত সম্পত্তিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যয়ভার সংকুলান হচ্ছিল না। আলী রাজা এক কঠিন অবস্থায় পড়েন। হাসন রাজার ডাক পড়লো। বাবা উপদেশ দিলেন এখন থেকে লক্ষণশ্রীর জমিদারী ব্যবস্থাপনায় তাকে মনযোগ দিতে হবে।
হাসন রাজা লক্ষণশ্রীর নায়েব শ্রীকৃষ্ণ গৌরাঙ্গ দত্তের সাথে বিষয়-আশয় স¤পর্কে মাত্র খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। এরমধ্যে একদিন দুঃসংবাদ এল যে, বড়ভাই দেওয়ান উবায়দুর রাজা ভীষণ অসুস্থ। বাবা আলী রাজার সাথে হাসন রাজা পরদিন লক্ষণশ্রী থেকে মধ্যরাতে রামপাশায় পৌছলেন। তিন দিন পর সবার উপস্থিতিতে ১২৭৮ বাংলার ভাদ্র মাসের ৩০ তারিখ রোজ বৃহষ্পতিবার মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অকালে মৃত্যুবরণ করেন উবায়দুর রাজা। ছেলের এই বিষাদময় ইহলোক ত্যাগে মানসিকভাবে ভেংগে পড়েন বাবা আলী রাজা এবং নিরন্তর রাতদিন কান্নায় আহাজারি অবস্থায় ছেলের চল্লিশা শির্ন্নী পার্বনে বাবা আলী রাজাও পুত্রকে অনুসরন করে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়লেন। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো হলো হাসন রাজার জন্যে। বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরই তরুণ হাসন রাজা জমিদারি সমস্ত দায়ভার কাঁধে চড়ালেন। কিন্তু তার মনে মনে এক মাতম মাতম ভাব শুরু হয়ে যায়।
তার জীবনের আবর্তনে গানের সৃষ্টির শতস্ফূর্ততায় হাসন রাজার অনুসন্ধান মিলে। বাবা ভাইয়ের মৃত্যুর বছর দুছেশ পর তার বৈবাহিক জীবন আর নারী ভোগের পালা শুরু হয়। হাসন রাজা শরিয়তের ভিতরে থেকেই তিনি সর্বমোট নয়টি বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ভুল বুঝবেন না যে হাসন রাজা একই সময় এক সাথে এতগুলো স্ত্রীর সংসার করলেন কিভাবে। না তা কিন্তু নয়। কোন কোন সময় দু তিন স্ত্রী ছিলিন, আবার দেখা যায় এই সময় এক স্ত্রী মারা গেছেন কিংবা তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন, পরবর্তীতে আরেকখানা বিয়ে করেন। জানা যায় কখনো তার একাধারে চারজন স্ত্রীর অধিক ছিলো না। এতসব বিয়ের মাঝে তার প্রেম প্রীতির যেমন অভাব ছিলো না:
সোনা বউ, সোনা বউ গো, তুর লাগিয়া হাসন রাজা ব্যাকুল
হাসন রাজা জানিয়াছে, তুমিই হƒদের ফুল ॥
ঘরের মাঝে পরদা দিয়া, বউ আমার থাকে
আন্দরে থাকিয়া বউয়ে, সকলের মন রাখে ॥
স্ত্রীগনের প্রানের মানুষ ছিলেন হাসন রাজা। তার সাত জন স্ত্রীর প্রায় সকলের কাছে তিনি ছিলেন অতি প্রিয় ও আরাধনার মানুষ। নারীর প্রেমে নিমগ্ন থাকলেও তার মধ্যে শ্রষ্টাপ্রেমের ভাইরম ভাইরম ভাবেরও কমতি ছিলো না। তিনি গেয়েছেন:
ঠাকুরের লাগি চিত্ত মোর, ভাইরম ভাইরম করে
কি বা জাদুু করল মোরে ঠাকুর আমারে ॥
না জানি কি জ্বালা গো হইল আমার অন্তরে
হুতাশ হুতাশ করে গো মনে, থাকতে নারি ঘরে ॥
চান্দমুখ না দেখিলে ঘরে রইতে নারি
তিলেক পলক মাত্র আমি বঞ্চিতে না পারি ॥
আলী রাজা দুনিয়াতে আর নেই। হাসন রাজার সকল দিক দিয়ে এক কঠিন অবস্থায়, তা সত্ত্বেও তাঁর সাহস ও ধৈর্য্যরে কমতি ছিল না। ১৮৭৪ সালে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সিলেটকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। আসাম চীফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ হিসাবে ঘোষনা দিলে সিলেটে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এবছরই বড়লাট নর্থব্রোক সিলেটবাসীদেরকে শান্তনা দেয়ার জন্যে সিলেটে আসেন এবং ওখানে একটি দরবার বসে। পিতার অনুপস্থিতিতে বড়লাটের দরবারে পুত্র হাসন রাজার সেখানে হাজির হন। মৃত্যুর ক’মাস আগে বাবার সঙ্গ নিয়ে পুত্র হাসন রাজার দেখা হয় সিলেটের ডেপুটি কমিশনার মি: সাদারল্যান্ড সাহেবের সাথে। সাহেব কিন্তু সেদিন বুদ্ধিদীপ্ত তরুন হাসন রাজাকে স্মরনে রেখেছিলেন। সমস্ত আসাম এবং সিলেটের ছোট ছোট রাজা এবং জমিদারদের উপস্থিতিতে মাত্র ২০ বছরের তরূন হাসন রাজাকে দেখামাত্রই কালেক্টার সাদারল্যান্ড ও বড়লাট সাহেব লক্ষ্য করলেন- হাসন রাজা একটি খোলা পালকি চড়ে বসে আছেন, পালকিটির সামনের দিকে দু’জন লাঠিয়াল, চার জন বেয়ারা কাঁধে চড়ানো, তার ঠিক মাথার উপরে বাঁশের একটি বড় রঙ্গীন ছাতা। তাঁর একপাশে পানদান, অন্যপাশে পিকদান হাতে নিয়ে দুজন বেয়ারা চলেছে, পিছনে পানির পাত্র নিয়ে আরেকজন এবং আরও ঘটিবাটির একটি বিরাট বহর। তাঁর দেহ সৌষ্ঠবে চমৎকৃত হয়ে বড়লাট নর্থব্রোক পরিচয় প্রদানকারী সাদারল্যান্ড সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন- ibÑWho is this young gentleman? Where does he live? উত্তর আসে: at Sunamganj. বড়লাট একটা আশ্চর্য হয়ে বললেন: But he looks like a upcountry rajah. কর্মচারী প্রত্যোত্তরে বললেন: Origin of his family come from Oudh. They migrated to Bengal in sixteenth century. সম্ভ্রমের সাথে সাদারল্যান্ড সাহেব তাঁকে স্বাগত জানান এবং তাঁর জন্যে আসন গ্রহনের ব্যবস্থা করা হয়।
হাসন রাজা স্বভাবগত কারণেই কোনোদিন যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষে ছিলেন না। শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে সবসময় তিনি উত্তম ব্যবহার, দান খয়রাত ও উদারতা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হাসন রাজা মিউজিয়ামে রক্ষিত পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী তলোয়ারখানা প্রকৃতপক্ষে হাসন রাজার জীবনে কোনোদিন ব্যবহার করেননি। বংশ পরম্পরায় তলোয়ারখানা হাসন রাজার কাছে এসে পৌঁছায় এবং সেটি আনুষ্টানিক মুহুর্তে বাহার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আসামের প্রথম চিফ কমিশনার কর্নেল আর,এইচ, কিটিং (১৮৭৪-৭৮) এর কাছে শিলংএ গিয়ে উপস্থিত হন হাসন রাজা। সুনামগঞ্জের উন্নয়ন প্রসঙ্গ ছিল তাঁদের আলোচনার বিষয়। (উল্লেখ্য কর্নেল কিটিং কর্তৃক দেয়া হাসন রাজাকে একটি সম্মানজনক সার্টিফিকেট তাঁর লক্ষণশ্রীর বাড়িতে বহুকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলদেশ স্বাধীণতার যুদ্ধের সময় বাড়িতে কে বা কারা লুটপাটের সময় অনেক জিনিসের সাথে সার্টিফিকেটটিও চিরদিনের জন্যে সরিয়ে নেয়।) শাসনকার্য্যরে সুব?
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: