পুস্তক: হাসনরাজা ও তাঁর সাধনা

পূর্ব পুরুষগন ও হাসন রাজা


প্রকাশিত:
২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৪৪

আপডেট:
২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৫৮

 

ভারতে সুলতানী যুগে হাসন রাজা-পরিবারের এক আদি পুরুষের নাম ছিল রাজা রামচন্দ্র সিংহদেব। ভরদ্ধাজগোত্রিয় সূর্যবংশসম্ভুত এই পুরুষের বসবাস ছিল বানারসীতে। অনেক বছর পরে রামচন্দ্র সিংহদেবের এক উত্তরসূরী পুরুষ তিলোত্তমচন্দ্র সিংহদেব কোন এক অজানা কারণে বানারসী থেকে রায়বেরিলিতে চলে আসেন এবং অযোধ্যার রাজ্যের আউদ রাজবংশীয় এক রাজকন্যাকে বিবাহ করে সেখানে বসবাস স্থাপন করেন।
তাঁদেরই আরেক উত্তরপুরুষ রাজা বিজয় সিংহদেব ষোড়শ শতাব্দির মাঝামাঝিতে পারিবারিক কুন্দল ও মনোমালিন্য এবং উপর্যপোরী মোগলদের আক্রমনের কারনে অযোধ্যা ছেড়ে দিয়ে এলাহাবাদে চলে আসেন এবং সেখান থেকে পরে বর্ধমানে এসে উপস্থিত হন। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁরই আপন ভাই দূর্জয় সিংহদেব। ভাগ্য বিপর্যয়ে পরে তাঁরা আরও পূর্বদিকে রওয়ানা দিয়ে বাংলার যশোর জেলায় উপস্থিত হন এবং হাবেলি পরগনার কাগদি নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তখন এই অঞ্চলকে বলা হতো দক্ষিণ রাঢ় এলাকা। পাঠানদের সহায়তায় দুইভাই বিজয় সিংহ ও দুর্জয় সিংহ এখানে একটি খন্ড-রাজ্য প্রতিষ্টিত করেন।
খুব সম্ভবত: এই সময়টি ছিল মোগল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাষনামল (১৬০৫-১৬২৭)। সে সময় দক্ষিণ রাঢ়ের এই ছোট রাজ্য পরিচালনার ভার ছোটভাই দুর্জয় সিংহ নিজের হাতে নিবার জন্যে সাংঘাতিক রকম জেদী হয়ে উঠেন। ভাইয়ের সাথে কোনরকম ঝগড়া বিদ্রোহ এড়ানোর লক্ষ্যে বড় ভাই রাজা বিজয় সিংহদেব রাজ্য ত্যাগ করেন এবং বিরাট একদল লোক নিয়ে বাংলার উত্তর-পূর্বদিকে যাত্রা করেন, তখন এই দুরের যাত্রীদলে সঙ্গী ছিল হিন্দু সমাজের বিভিন্ন স্থরের নানান বর্ণ-শ্রেনীর্ভূক্ত লোক। এদের মধ্যে পারিবারিক কুল-পুরুহিত থেকে শুরু করে গুরু, ব্রাম্মন, অভিজাত কায়স্থ, নাপিত, ধুপা, তেলি, মালি, কৈবর্ত, মাঝি এবং জেলেও ছিলো। অবশেষে তিনি সিলেট অঞ্চলের বিশ্বনাথ উপজেলাধীন বর্তমান কোনাউরা নামে অভিহিত এক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। কৌড়িয়া পরগানার অন্তর্ভুক্ত কুনাউরায় এখনও রাজা বিজয় সিংহের গড়, দীঘি ও দালানাদির চিহৃ পাওয়া যায় বলে দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ তার লেখায় উল্লেখ করেন। দেওয়ান বাড়ীর ইতিহাসে বিবৃত আছে যে, তাঁর রাণীর নাকের একটি স্বর্নখচিত বহুমূল্য প্রস্তরযুক্ত নথ পরে এই পরিবারের বংশধর দেওয়ান আজিজুর রাজা চৌধুরীর কাছে ছিল। দীর্ঘ পথ-ভ্রমনের পর রাজা বিজয় সিংহদেব শারিরীকভাবে ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর সন্তান যুবরাজ অজিত সিংহদেব (১৫৯৩-১৬৭৮) এই ছোট রাজ্যর ভার গ্রহন করেন।
এই এলাকায় নুতন জনবসতি গড়ে তুলার উদ্দেশ্যে অজিত সিংহদেব বহু দুর দুরান্তের লোকজনকে উৎসাহিত করেন । অজিত সিংহদেব যখন মারা যান, তখন তাঁর তিন পুত্র রাজা সুবিধরাম সিংহদেব (১৬২৩-১৬৮৮), রাজা ব্যথিতরাম সিংহদেব এবং রাজা শ্রীনাথ সিংহদেব এর মধ্যে বয়োজৈষ্টই রাজ্যভার গ্রহন করেন। সুবিধরামের দুই পুত্র রাজা অভিমূন্যরাম সিংহদেব (১৬৫১-১৭০৬) ও রাজা প্রতাপ সিংহদেব (১৬৫৪-১৭১৬)। পরবর্তীকালে দায়িত্বশীল রাজা অভিমূন্য সিংহদেবের একমাত্র পুত্র রাজা রনজিৎ সিংহদেব (১৬৭৬-১৭৪৮) পাশা খেলার উদ্দেশে তাঁর এক ব্রাম্মণ বন্ধুর বাড়ীতে প্রায়ই ঘনঘন যাতায়াত করতেন। এই ব্রাম্মণ বন্ধুর বাড়ীটি ছিল কাপনা নদীর তীরে। কিংবদন্তী যে, রাজা রনজিৎ কোনদিনই তাঁর বন্ধুর সাথে খেলায় জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু একবার খেলতে গিয়ে তিনি জায়গা বাজি রেখে ভগবান শ্রী রামের নামে খেলার চাল দেন এবং শেষপর্যন্ত খেলায় প্রথমবারের মত জয়ী হন। এই জয়ের কিছুকাল পরই তিনি কুনাউরা ছেড়ে দুই মাইল দক্ষিণপূর্বে তাঁর আবাসস্থল গড়ে তুলেন এবং তাঁর বংশের আদিপুরুষ রাজা রামচন্দ্র সিংহ দেবের নামে এই এলাকার নামকরন করেন ‘রামপাশা’। রামপাশায় পরিখাসহ তিনি একটি প্রাসাদদূর্গ গড়ে তুলেন। এই দূর্গ-প্রাচীরের ধংসাবশেষ আজো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
রনজিৎ সিংহদেবের পাঁচ পুত্রসন্তান ছিলেন, যথাক্রমে সুন্দরাম সিংহদেব, সম্পদরাম সিংহদেব, বানারসীরাম সিংহদেব, জগৎরাম সিংহদেব এবং চান্দিরাম সিংহদেব। তৃতীয় পুত্র বানারসীরাম সিংহদেব ( ১৭০৪-১৭৮১) উত্তর ভারতের বানারস শহরে পিতামাতার তীর্থভ্রমনের সময় সেখানে জন্ম গ্রহন করেন। জন্মস্থানের নামের সাথে মিল রেখে তাঁর নামটি হয় ‘বানারসীরাম’। রনজীৎ সিংহদেবের ষাট বছর বয়স্কালে তাঁর প্রথমপুত্র সুন্দররাম সিংহদেব ইহলোক ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় পুত্র সম্পদরাম সিংহদেব গান-নৃত্য ও মদ্যপান নেশায় সর্বক্ষন আসক্ত থাকায় পিতা রনজিৎরাম সিংহদেবের তৃতীয় পুত্র রাজা বানারসী সিংহদেবকেই শাষনকার্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পন করেন। বানারসীরাম পিতার বাধ্য ও উপযুক্ত পুত্র। সায়সম্পদ, লোকলস্কর ও এলাকা উন্নয়নে মনোযোগী থাকেন। একসময় সিলেটের ফৌজদার (নবাব) আলীকুলি বেগের সাথে এক ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখায় তিনি এই এলাকার উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে একজন অত্যন্ত প্রথিতযশা স্থানিয় শাসক হয়ে দাড়ান। উল্লেখ্য সিলেটের ফৌজদারগনকে তখন নবাব বলা হতো। শোনা যায় নবাব আলীকুলি রামপাশার ঐতিহাসিক পরিখাযুক্ত বাড়িটি পরিদর্শন করে প্রজাহিতৈষী বানারসীরামের পরিচয় পেয়ে তার প্রশংসায় পঞ্চমূখ হন এবং তাঁর সুপারিশেই উর্দ্ধতন মোগল শাষক কর্তৃক ১৭৪৬ সালে বানারসীরামকে ‘দেওয়ান’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। খাঁন বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা জানান বানারসী সিংহদেবের দয়াদ্রচিত্ত ও দানশীলতার পরিচয় পেয়ে ফৌজদার আলীকুলী বেগ (১৭৪৪-১৭৪৮)এর এক বছরের কর অনাদায় সম্পূর্নভাবে মৌকুফ করে দিন।
ওদিকে ফওজদার তথা নবাব আলীকুলির সময় থেকেই পুরো সিলেট জুড়ে সীমান্তে বসবাসকারী পাহাড়িয়া খাসিয়া ও কুকী জাতি প্রায়ই সমতল এলাকায় নেমে এসে লোকের উপর নানান রকম অত্যাচার অবিচার করতো।
আলিকুলির পর নবাব নওয়াজিশ খাঁ অত্যন্ত উদারপন্থী নবাব ছিলেন। নানা হিন্দু গুনিজনকে তিনি সহায়-সুবিধা ও ভূমিদান করে তাঁদের মন জয় করতেন। আনুমানিক ১৭৫৯ সালের প্রথম দিকে বানারসী সিংহদেব তাঁর পুত্র বিরেন্দ্ররামকে নিয়ে নবাবের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং এভাবে ফৌজদারের সাথে কৌড়িয়ার রাজবংশেরও একটি সৌহার্দ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠে। রাজা বিরেন্দ্ররাম সিংহদেব (১৭২৯-১৭৯৭) হবুকালের মরমি কবি হাসন রাজার প্রপিতামহ অর্থাৎ সিলেটিরা বড়বাবা। তিনি হিন্দু রক্ষনশীল সমাজ ও পরিবেশের ভিতরে বসবাস করেও এক দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেন। তাঁর খোলাখুলি মনোভাবের কারনে জাত-বেজাত উপেক্ষা করে তিনি সকল মানুষের সাথে মিশতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে দার্শনিক মওলানা রুমীর বিখ্যাত কাব্য ‘মসনবি’ পাঠ তাকে সম্মোহিত করে। ওদিকে তাঁর গোত্রিয় ভাইয়েরা একদিন তাঁকে নিয়ে মৃগয়ায় যাওয়ার পথে মাহুতের (হাতিচালক) হাত থেকে পানি পান করা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে এবং তাঁদের সঙ্গ ত্যাগ করে রামপাশার বাড়ীতে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। উপর্যপোরি কাশিধামে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতেও তাকে বলে। বাড়ীতে ফিরে এসে পিতা বারানসীরামের কাছে ঘটনাটি বর্ননা করার পরও তাঁর কোনরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে বিরেন্দ্ররাম তাঁর ঘোড়াটি নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং সিলেটে পৌছে ফৌজদার নওয়াজিশ মোহম্মদ খানের (১৭৫৯-১৭৬২) কাছে ‘বাবু খাঁন’ নাম ধারন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন ।
রাজা বাবু খানের ধর্মান্তরের সাথে সাথে এলাকার নিম্ন-বর্ণ বহু হিন্দু পরিবারগনও তাঁকে অনুসরন করে এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। তাঁদেরই উত্তরসূরীরা এখনও রামপাশা, মনোহরপুর এবং লক্ষনশ্রীর তেঘরিয়া মৌজাতে বংশ পরম্পরায় বসবাস করছে বলে দেওয়ান বাড়ির ইতিহাসে বর্ণীত রয়েছে। রাজা বাবু খানের ধর্মান্তরের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী শ্রীমতি সর্বানন্দা দেবি হিংগাজিয়ার পিত্রালয়ে অবস্থানেকালে গোপনে রাতের বেলায় আত্মহত্যা করেন। এহেন পরিস্থিতিতে বানারসী সিংহদেব সিলেটের ফৌজদার নওয়াজিশ মোহম্মদ খানের কাছে একটি রুপার হাতি উপহার পাঠান এবং অনুরোধ জানান পাঠানো দূতের সাথে যেনো ছেলেকে ফেরৎ দেয়া হয় । কিন্তু ফৌজদার তাতে রাজী হলেন না। এরপর তিনি দ্বিতীয় অনুরোধ জানালেন যে, পুত্রকে যেনো তাঁদের সমতূল্য একটি অভিজাত মুসলিম পরিবারের কন্যার সাথে বিয়ে দিয়ে বংশের কৌলিণ্য রক্ষা করা হয়। এবারের অনুরোধটি ফৌজদার সাহেব রক্ষা করলেন। সুনামগঞ্জে কর্মরত সেনাপতি কোরেশ বংশীয় অয়েজদি কোরেশির বোন সহরজাহান বানুর সাথে দেওয়ান বাবু খানের বিবাহ বন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়। পুত্রের ধর্মান্তরে বানারসী সিংহদেব ভেঙ্গে পড়লেও তাঁর জমিদারী পরিচালনায় ফৌজদারের সাথে কোনরূপ সম্পর্কের ভাটা পড়েনি। পরবর্তীকালে অবশ্য ফৌজদারের সাথে যোগসাজসে বানারসীরাম সিংহদেব পুত্র বাবু খান ও পুত্রবধুকে সাদরে নিজগৃহে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন । এই সময় পিতা ও পুত্র উভয়ই নিজ নিজ ধর্ম ও বিশ্বাস অটুট রেখেই কোনরুপ দ্বিধাদন্ধ ছাড়াই ¯েœহ-প্রীতি, শ্রদ্ধা-ভালবাসা সত্যিকার মানবপ্রেমের রুপ ধরিয়ে তাঁদের খাটি সুসম্পর্ক চিরস্থায়ী করা হয়। বানারসীরাম ওই সময় কাটলিপাড়ায় দুটি মন্দির তৈরী করে একটিতে নিজ গৃহদেবতা বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার ধর্ম ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বেশ কিছু স্থাণীয় মন্দির উপাসনালয়ের নির্মানকার্য্য করিয়ে দিন বাবু খান।
কিছুদিনের ভেতরেই বাবুখানের স্ত্রী সহরজাহানের গর্ভে জন্ম নেয় দুই পুত্র দেওয়ান কেশোয়ার খান (১৭৬০-১৭৯৮)ও দেওয়ান আনোয়ার খাঁন (১৭৬২-১৮০০)। হাসন রাজার জন্মের ঠিক ৭৬ বছর আগে বিখ্যাত রেসিডেন্ট কালেক্টার লিন্ডসে সাহেব ১৭৭৮ সালে সিলেট এসেছিলেন। সে সময় আনোয়ার খাঁনের বয়স ছিল মাত্র বিশ। লিন্ডসে সাহেবের দীর্ঘ বার বছর সিলেটে অবস্থানকালে একসময় মহরম উদযাপন করতে গিয়ে এক ভীষন বর্ন-দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধে। চারদিক তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এই সময় কৌড়িয়া পরগনা তথা সারা বিশ্বনাথ জুড়ে নব্যমুসলিম রাজা বাবু খানের সর্বতো প্রয়াসে এলাকায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এক সংহতি-শান্তির পরিবেশ বজায় থাকে। এর পরপরই বানারসী সিংহদেবের মৃত্যু পুত্রপৌত্রদেরকে শোকাভিভূত করে তুলে।
বিরেন্দ্ররামের পুত্র আনোয়ার খানই হলেন হাসন রাজার দাদা। আনোয়ার খান ওরফে দেওয়ান আনোয়ার রাজা পূর্নবয়স্ক হওয়ার পরই তাঁর মামা ‘অয়েজদি চৌধুরী’ তাঁর নিজের কন্যা দৌলতজানকে তাঁর কাছে বিবাহ দিন। বিশাল হৃদয়ের মানুষ আনোয়ার খান জীবনে বহু মসজিদ ও মন্দির নির্মান করান। ৩৮ বছরের ক্ষনস্থায়ী জীবনে রাজাগঞ্জের আখড়া, টেংরার জগন্নাৎ আখড়া, গোপাল গাওয়ের আখড়া, রামপাশার মসজিদ, বড়দিঘি খনন প্রভৃতি নির্মানকাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৭৯৩ সালের দিকে আমাদের কবির পূর্বপুরূষ ভ্রাতৃদ্বয় দেওয়ান কেশোয়ার খান ও আনোয়ার খান নিজ নিজ পুত্রগন কামদার খান ও আলম রাজা এর নামে তাঁদের পূর্বের পারিবারিক সায়সম্পত্তি-সব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করান। তাঁদের দুটো তালুক আলম রাজা তালুক ও কামদার খান তালুক সিলেটের বৃহত্তর তালুক হিসাবে পরিচিত ছিল। এই সময় বিশ্বনাথ ছাড়াও সিলেট সংলগ্ন শহরের আশপাশ জুড়ে, ফেন্চুগঞ্জে, মৌলভিবাজার ও ছাতকে কয়েকটি তালুক বন্দোবস্থ নেয়া হয়।
ওদিকে লক্ষনশ্রী পরগনার তেঘরিয়াতে অয়েজদি কোরেশী তাঁর অপর কন্যা ছবর জাহানকে এক দক্ষ তীরন্দাজের পরিচয় পেয়ে সদবংশীয় জালশুকার জমিদার-পুত্র মোহাম্মদ লায়েক চৌধূরীর কাছে বিবাহ বন্ধনে কন্যাদান করেন এবং নিজঘরের পাশে তাঁদের জন্যে বাসস্থান বানিয়ে দিন। লক্ষনশ্রী পরগনার দুই নম্বর তালুক মোহম্মদ লায়েক নামে বন্দোবস্ত হয়। কথিত আছে, উক্ত মোহাম্মদ লায়েক একদিন নিজ শশুরের বাড়ীর দেয়ালের উপর দাড়িয়ে নদীর উত্তর পারে এক খাসিয়া বা গারমর্গে তীর বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে আর কখনও তারা দক্ষিণ পাড়ে এসে অত্যাচার করার সাহস পেত না।
আনোয়ার খানের স্ত্রী দৌলত জাহানের গর্ভে জন্ম নেন দেওয়ান আলম রাজা। ১৮০০ সালে স্ত্রী দৌলতজাহান বানু যখন অন্তসত্বা ঠিক এসময় স্বামী আনোয়ার খানের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পরপরই একই মাসে কনিষ্ট পুত্র আলী রাজার জন্ম হয় ৭ অগ্রাহায়ন ১২০৭ বাংলায়। দেওয়ান আনোয়ার খান ও তাঁর ভাই দেওয়ান কেশোয়ার খান ইহলোক ত্যাগ করায় আলম রাজা ও চাচাত ভাই কামদার খান তাঁদের আপন আপন পিতার সহায়-সম্পত্তির অধিকারী হন। কিন্তু বেশীদিন যায়নি কামদার খানেরও মৃত্যু ঘটে। আলম রাজা মানসিকভাবে মুসড়ে পড়েন। এমনি অবস্থায় অধিক পানসুপারী খাওয়ার অভ্যাসকালে একদিন রাত্রে তিনি বিষমে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়েন। মাত্র তেত্রিশ বয়সকালের মৃত্যুতে তাঁর ছোট ভাই উনিশ বছরের যুবক আলী রাজা হতচকিত হয়ে উঠেন। আলম রাজা বিবাহ করেছিলেন মৌলভিবাজারের করনসির মুতিরগায়ের দেওয়ান পরিবারে। এই পরিবারের এক দীর্ঘ কেশবতী পরমাসুন্দরী যুবতী কন্যা যখন বিধবা হলেন, তখন সেই স্ত্রীকে বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সন্তানহীন অপরুপাকে অন্যত্র বিবাহ দেয়া হয়। অন্যদিকে কামদার খানের মাতুলালয় প্রসিদ্ধ জমিদার বাড়ী পাড়–য়া থাকায় সেখানে তিনি সম্পত্তি লাভ করেন। এখানে উল্লেখ্য দুই ইতিহাস লেখক অচ্যুতচরণ চৌধুরী ও সৈয়দ মুর্তাজা আলীর মতে, ছাতক বাজার স্থাপিত হওয়ার আগেই পাড়–য়া বা লিন্ডসে সাহেব বর্ণিত পান্ডুয়া বর্তমান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। একসময় অঞ্চলটি একটি প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে চালু ছিল। কামদার খান মারা যাওয়ার পর তাঁর মাতুলালয়ের সম্পত্তি শেষ পর্যন্ত আলী রাজার হাতে চলে আসে। এই পরিবারে আপনজনের মৃত্যু জন্ম জন্মান্তর ধরে যেনো আকস্মিকতায় ভরপুর। এমনি এক আকস্মিকতায় আলী রাজার মনকে ভাবিয়ে তুলে।
প্রথমদিকে আপন ভাই এবং চাচাত ভাইয়ের সকল সায়সম্পদ ও তাঁর বিশাল জমিদারী এস্টেইট-গুলো যেনো আলী রাজার জন্যে সামলানো কঠিন ছিলো। এই সমস্ত কিছুতেই তিনি নির্লিপ্ত হয়ে উঠেন। বাপহারা এই সন্তানকে মা দৌলতজাহান প্রানের অধিক ভালোবাসতেন। আলী রাজা পরিবারিক রেওয়াজ অনুযায়ী ফারসী, আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় গৃহশিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন।
বাবা ও বড়ভাইয়ের মতো আলী রাজাও সৌখিন ছিলেন। বাপ-দাদার আমল থেকেই তাঁর হাতি ধরার অভিজ্ঞতা এবং কয়েকবছর হাতী বেচাকেনার ব্যবসাও করেন তিনি। লিন্ডসে সাহেবের দেয়া তথ্যে মিলে যে, তখন সিলেট অঞ্চলে দু’চারটি দামী ব্যবসার মধ্যে একটি ছিলো হাতি ব্যবসা এবং সিলেটের এই হাতীগুলো বিভিন্ন প্রয়োজনে সমস্ত ভারতের দুরদুরান্ত শহরগুলাতে সরবরাহ করা হতো। হাসন রাজা এক জায়গায় লিখেছেন আলী রাজার অগনিত হাতি বজ্রাঘাতে মারা যাওয়ার পরও তিনি হাতি পালনে পিছপা ছিলেন না।
“সুন্দর না লাগে হাতী, অল্প কালা হইলে
মালিকের না দু:খ লাগে, সেইসব হাতী মইলে
এই মত কত হাতী, গেছে আমরার মরি
একদিন আমার পিতায়, না চাইলেন ফিরি”
ইতোমধ্যে মা দৌলত জাহান বানু ছেলের ২৫ বছর বয়সে প্রথম বিবাহ করান দিনারপুর পরগনার সদরঘাট মৌজার দেওয়ান হায়দর গাজীর কন্যাকে। এই স্ত্রী অন্তসত্বাকালে মারা যান। এই সময় আলী রাজা মউজুফ বুজুর্গ ‘টাটসা মৌলা’ নামে প্রসিদ্ধ মোহম্মদ গাজীর ভক্ত হয়ে উঠেন এবং বৈরাগ্য পথে এগুতে টাটসা মৌলা তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। অবশেষে দিনারপুর পরগনার শতক বর্তমানে আতানগিরি গ্রামনিবাসী দেওয়ান সায়েস্থা রাজার কন্যা নফীজা বানুকে বিবাহ করায় প্রথম সন্তান দেওয়ান ওবায়দুর রাজার জন্ম হয় ১৮৩২ সনে। সিলেট শহরে আলী রাজা তৃতীয় বিবাহ করেন তাঁর এক বন্ধু রহমান খানের বিধবা স্ত্রী নুর বিবিকে। এই বিবির গর্ভে জন্ম নেন সঈফা বানু ১৮৫১ সালে, এবং আরেক পুত্র দেওয়ান মোজাফ্ফর রাজা ১৮৫৩ সালে। সুনামগঞ্জে লক্ষণশ্রীর জমিদার পরিবারে তাঁর আপন খালাতভাই আমির বক্স চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৮৫৩ সালে তাঁর বিপন্ন স্ত্রী হুরমতজাহান বানুকে সর্বশেষ বিবাহ করেন। আর এমনই মহান কর্তব্য পালনশেষে যে শিশুটির জন্ম হয় ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর অর্থাৎ ৭ই পৌষ, ১২৬১ বাংলা বর্ষে তিনি হলেন আমাদরে আলোচ্য লোক সংগীত ও লোক-দর্শনের বরেন্য মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজা।
আলী রাজার মধ্যে ছিল অনাবিল নিশর্ত ও নিস্বার্থ বদান্যতা। হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে তিনি দানশীলতার কাজে মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, আখড়া, মক্তব নির্মানে অনেক দান খয়রাত কওে গেছেন। আলী রাজা ছিলেন সততা ও সত্যের মানসমূর্তি। একবার এক লোক আলী রাজার উপর একটি মামলা করে সাক্ষী মানে তাঁরই পুত্র ওবায়দুর রাজাকে। বাবার বিরোদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ইতস্তত করায় আলী রাজা পুত্রকে সত্য সাক্ষ্য দিতে উপদেশ দেন। নিজ পিতার বিপক্ষে এত সাহসভরে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসায় বিচারক এই সত্যবাদিতায় অভিভূত হয়ে সমস্ত অভিযোগটি খারিজ করে দেন। আলী রাজার তালুকের পর তালুক নিলামের সময়ও দেখা যায় একদিন ভাদেশ্বর নিবাসী এক চৌধুরী সাহেব ৫০০ শত টাকার জন্যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিলাম হওয়ার আশংকায় আলী রাজা সাহেবের কাছে এসে সাহায্যপ্রার্থী হন। তখন তাঁর নিজের অবস্থা বিবেচনা না করেই তিনি তৎক্ষনাৎ খাজাঞ্চীকে আদেশ করেন চৌধুরীকে ৫০০ টাকা দেয়ার জন্যে। খাজাঞ্চী এতে মন খারাপ করলে তিনি বললেন ‘ ৫০০ টাকায় আমার কোন কাজ উদ্ধার হবে না, বরঞ্চ এই টাকায় ঐ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি রক্ষা পাবে।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top